ইসমাইল আলী: ২০০৯ সাল থেকে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে প্রতিবছরই বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা বাড়ছে। যদিও ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। এতে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। আর তুলনামূলক কম দামে সে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসান ছাড়িয়ে গেছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা।
ঘাটতি মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর ঋণ নিচ্ছে পিডিবি। আবার এ ঋণের ওপর তিন শতাংশ সুদও দাবি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও লোকসানের কারণে ঋণ পরিশোধ না করে তা ভর্তুকিতে রূপান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। প্রতিবারই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণাতে সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ভর্তুকি পায়নি না পিডিবি।
সম্প্রতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পিডিবি। এর তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ১৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অথচ গত অর্থবছর শেষে পিডিবির স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৩২০ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ স্থায়ী সম্পদের চেয়ে আট হাজার কোটি টাকা বেশি পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে পিডিবির।
পুঞ্জীভূত লোকসান বা দেনার পরিমাণ যে উত্তরোত্তর বাড়ছে, গত সেপ্টেম্বরে বিইআরসির গণশুনানিতেও তা তুলে ধরে পিডিবি। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি জানায়, ঋণ নিয়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার অর্থের অভাবে পিডিবি নিজেদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওভারহোলিং, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছে না। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক বিবরণী গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর সে বছর পুঞ্জীভূত লোকসান ছিল ৪৫ হাজার ৩৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আর পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৬৪৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৭৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
বেসরকারি খাত থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনা শুরু করার পর থেকেই বাড়তে থাকে বিপিডিবির দেনার পরিমাণ। কারণ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে পিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসান অনেক কম ছিল। তবে গত ৯ বছরে তা পাঁচগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসান ছিল ৯ হাজার ৪৩৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তা মাত্র ৬৩৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বাড়ে। এতে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭৮ কোটি ৯ লাখ টাকা।
পরের অর্থবছর আরও প্রায় এক হাজার কোটি টাকা যোগ হয়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ১২৪ কোটি ১১ লাখ টাকায়। ২০১০-১১ অর্থবছরেই চার হাজার টাকার বেশি নতুন লোকসান যোগ হয়। এতে বিপিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৭১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আরও প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা যুক্ত হয়ে পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়ায় ২২ হাজার ২০০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে বিপিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
এ বিপুল আর্থিক চাপ সামাল দিতে পিডিবিকে প্রদত্ত পুরো ঋণ মওকুফ বা ভর্তুকিতে রূপান্তরে বিকল্প নেই বলে মনে সংস্থাটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমান সরকার দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি নিরসনের লক্ষ্যে সরকারি খাতের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। তবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনায় পিডিবির বড় অঙ্কের লোকসান হচ্ছে। এজন্য ঋণ মওকুফ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী পিডিবির এডিপির আওতায় সরকার যে অর্থ প্রদান করে তা ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত ৪০: ৬০ রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী বিউবোর ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত ১১৪: (১৪)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী তা ৪০: ৬০ এ উন্নীত করার লক্ষ্যে বিউবোর ঋণকে ইক্যুইটিতে রূপান্তর করা দরকার।
এছাড়া বর্তমানে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিউবোতে ইসিএ ফাইন্যান্সিংসহ ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণপূর্বক একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ঋণ প্রদানের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য বিউবোর ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট ও ব্যালান্স শিট অবলোকন করে থাকে। এগুলোয় ইক্যুইটি ঋণাত্মক থাকায় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে ও সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ঋণকে ইক্যুইটিতে রূপান্তরের জন্য বিউবোকে পরামর্শ প্রদান করেছে।
এ অবস্থায় উপরোক্ত বর্ণনা অনুযায়ী ইক্যুইটি ধনাত্মক করার লক্ষ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় ঘাটতি বাবদ প্রদত্ত ঋণকে সুদসহ ইক্যুইটিতে রূপান্তর বা বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী সরাসরি ভর্তুকি প্রদানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিভিন্ন বিদেশি বেসরকারি ব্যাংক ও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পিডিবি বেশ কিছু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। তারা বিশাল অঙ্কের পিডিবির বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে। এছাড়া সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পিডিবির এ ঋণের বোঝায় চাপা পড়তে হয়েছে। তাই এ ঋণকে ভর্তুকি বা মওকুফের দাবি জানানো হয়েছে।