Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 11:54 pm

পুরাণ ও ইতিহাসে দুর্গাপূজা

অঞ্জন আচার্য : কৃত্তিবাস সংকলিত বাংলা রামায়ণের কাব্যিক সাহিত্যে পরিব্যাপ্ত আছে দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গাপূজার বিশদ বর্ণনা। ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়Ñলিখিত সাহিত্য সৃষ্টির আগেও হিমালয়বাসিনী দেবী দুর্গাকে শক্তির আধার হিসেবে মুক্তিপ্রদায়নীরূপে পূজা-অর্চনার। পাঁচ হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধু সভ্যতার মহেনজোদারোতে খনন করে যে মূর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, সেখানেও অতসী পুষ্পাবর্ণ, জটাজটধারিণী সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা অর্চনা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলা রামায়ণ সৃষ্টিতত্তে¡র পূর্ববর্তী রচিত সাহিত্যকর্মের ইতিহাসে দুর্গোৎসবতত্ত¡ ও প্রাসঙ্গিক প্রায়োগিক বর্ণনায় উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবে। মার্কেন্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণসহ শাস্ত্রীয় সব গ্রন্থে দেবী দুর্গার বহুমুখী উপাসনার রীতি ও পূজা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সাবলীলভাবে। জ্ঞানশক্তি, সম্পদশক্তি, সংগ্রাম কৌশল শিক্ষায় আসুরিক শক্তির বিনাস সাধনে সিদ্ধিশক্তির সম্মিলন প্রক্রিয়াও শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলোয় বিধানাকারে অবতীর্ণ বিষয় হিসেবে বিদ্ধৃত আছে। পৌরাণিক, ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক ও সাহিত্যিক বর্ণনার চেতনা থেকে সনাতন ধর্মবিশ্বাসীরা শক্তির উৎস চিহ্নিত করে অকৃত্রিম ভালোবাসা, ক্ষমা, সরলতা, পবিত্রতা ও ত্যাগের আদর্শ হিসেবে করে থাকেন দৈবশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গাপূজা-অর্চনা ও আরাধনা।

বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ আছে। দুর্গাকে ডাকা হয় আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা প্রভৃতি নামে। বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যানে দুর্গাপূজার প্রচলন-সম্পর্কিত বিবিধ কিংবদন্তি রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, দুর্গোৎসবের প্রবর্তক স্বয়ং কৃষ্ণ। আদিবৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজার পর মধুকৈটভের ভয়ে দুর্গার আরাধনা করেন ব্রহ্মা। তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেন মহাদেব, ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে সংকটাপন্ন হয়ে। দুর্বাশা মুনির দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র চতুর্থবার দুর্গাপূজা করেন। এরপর থেকে পৃথিবীতে মানব জাতির মধ্যে দুর্গাপূজার প্রচলন। পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু দেবী দুর্গার আরাধনা করেন; এর উল্লেখ আছে দেবীভাগবত পুরাণে।

মার্কন্ডেয় পুরাণের অংশ ‘দেবীমাহাত্ম্যম্’, যেটি ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’ নামে পরিচিত, সেখানে দুর্গোৎসব প্রচলনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনি হলো মহিষাসুর বধের কাহিনি। পুরাকালে মহিষাসুর একশ বছর যুদ্ধের পর দেবতাদের কাছ থেকে জয় করেন স্বর্গরাজ্য। বিতাড়িত দেবতারা প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা, পরে শিব ও নারায়ণের কাছে যান। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবের মুখমণ্ডল এবং ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতার শরীর থেকে নির্গত মহাতেজ মিলিত হয়ে হিমালয়ে অবস্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে এক নারীমূর্তি ধারণ করে। একেক দেবতার প্রভাবে উৎপন্ন হলো একেক অঙ্গ। বাহন হিসেবে হিমালয় দেবীকে সিংহ দান করলেন। দেবতাদের সম্মিলিত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। দুর্গাপূজার উল্লেখ রয়েছে রামায়ণে। তবে মূল রামায়ণে দুর্গোৎসবের কোনো বর্ণনা না থাকলেও কৃত্তিবাস ওঁঝা তার বাংলা রামায়ণে কালিকা পুরাণের ঘটনা অবলম্বনে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা দিয়েছেন। আবার রাজা সুরথ বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে এর আরেক নাম ‘বাসন্তী পূজা’। বাসন্তী পূজা হয় চৈত্রের শুক্লপক্ষে, আর শারদীয় দুর্গাপূজা হয় আশ্বিনের শুক্লপক্ষে। বাংলায় শারদীয় দুর্গাপূজাই বেশি জনপ্রিয়। শুক্লা ষষ্ঠীতিথিতে দেবীর বোধন হয়; সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে পূজা দিয়ে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ পক্ষটিকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষ শুরু হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন। এ দিনটি ‘মহালয়া’ নামে পরিচিত।

কথিত আছে, বঙ্গদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। এটি ঘটে সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) রাজত্বকালে। তবে মতভেদ রয়েছেÑনদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-৮৩) বাংলায় দুর্গাপূজা প্রবর্তন করেন। রঘুনন্দনের (১৫০০-১৬০০ শতক) ‘তিথিতত্ত¡’, জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০-১১৫০) ‘দুর্গোৎসবনির্ণয়’, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) ‘দুর্গোৎসববিবেক’, কৃত্তিবাস ওঁঝার (আনু. ১৩৮১-১৪৬১) ‘রামায়ণ’, বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ‘ক্রিয়াচিন্তামণি’ প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় ধারণা করা হয় দশম অথবা একাদশ শতকেই বঙ্গদেশে দুর্গাপূজা প্রচলিত ছিল। ইতিহাস জানা আছে এমনভাবেই সম্রাট আকবর বাংলা-বিহারের দেওয়ান নিযুক্ত করেন রাজা কংসনারায়ণকে। তবে বয়সের কারণে কংসনারায়ণ দেওয়ানি ছেড়ে রাজশাহীর তাহেরপুরে এসে আত্মনিয়োগ করেন ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে। আহবান করেন তাহেরপুরে এসে তার জমিদারির ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মহাযজ্ঞের জন্য। ওই সময় নাটোরের বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা ছিলেন বংশানুক্রমে তাহেরপুর রাজাদের পুরোহিত। এদের মধ্যে ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী নামে একজন বাংলা-বিহারের বিখ্যাত পণ্ডিত। রাজা রামচন্দ্রের বিধানে ভক্তিসহ দুর্গোৎসব করলে সর্বযজ্ঞের ফল লাভ সম্ভব বলে মতপ্রকাশ করেন রমেশ শাস্ত্রী। উপস্থিত অন্য পণ্ডিতরাও ওই মতের সঙ্গে একমত হন। আর রাজা কংসনারায়ণ সে মতেই পূজার বিশাল আয়োজন করেন। আর এখান থেকেই শুরু হয় মহাধুমধামে দুর্গোৎসব। তবে এতদিনকার ইতিহাসে দেখা দিল মতান্তর। সম্প্রতি ইতিহাস পর্যালোচনায় কয়েকজন বিশ্লেষক অভিমত দিয়েছেন : কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। কিন্তু তারও আগেকার সাহিত্য ও অন্যান্য সূত্রে বাংলায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত যে বিপুল ব্যয়ে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেন, তা-ই সে যুগের জনমানসে দুর্গাপূজার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিল। আর সে থেকেই কংসনারায়ণী মিথের উৎপত্তি।

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।’ তাঁর মতে, বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। শরৎঋতুর আরম্ভেও হতো। তিনি বলেন, বৈদিক যজ্ঞ ও দুর্গাপূজার মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্য একই। বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য, ধন-ধান্য-পুত্র, রোগমুক্তি ও শক্তিনাশের শক্তি প্রার্থনা। যোগেশচন্দ্র আরও দেখাচ্ছেন, দুর্গাপূজার মন্ত্রে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির পরিব্যাপ্তি কতটা। বৈদিক হিন্দুধর্ম ছিল যজ্ঞসর্বস্ব। দুর্গাপূজাও দেখি, দেবীকে যজ্ঞভাগ গ্রহণে আহবান জানানো হচ্ছে এবং পশু বলি দেওয়ার সময় বলা হচ্ছে যজ্ঞের নিমিত্তই পশুর সৃষ্টি। যোগেশচন্দ্রের তাই অনুমান, বৈদিক শারদযজ্ঞই তন্ত্রের প্রভাবে পর্যবসিত হয়েছে আধুনিক দুর্গোৎসবে। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। ৯ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রঘুনন্দনের (১৫৪০-৭৫) ‘দুর্গাপূজা তত্ত¡’ গ্রন্থটি। নবদ্বীপের এই স্মার্ত পণ্ডিতের লেখা গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। এসব বিধান তিনি নিজে সৃষ্টি করেননি। বরং আগের পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে পূজাপদ্ধতি লিখেছেন। কোনো কোনো বিধানের পৌরাণিক প্রমাণ দিতে পারেননি। একে তিনি বলেছেন আচার, দেশাচার বা কুলাচার। আচার তাকেই বলে, যা দেশে বা বংশে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। স্মৃতিশাস্ত্রের ধর্ম যা কিছু পুরোনো, সে পৌরাণিকই হোক আর আচারগতই হোক, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া ও নতুনকে বাতিল করা। কংসনারায়ণের বংশে প্রথম দুর্গাপূজার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা উদয়নারায়ণ। সেটা ছিল ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ। রঘুনন্দন তখন বাঙালি হিন্দুসমাজের অন্যতম প্রতীক। এদিকে কারও কারও মতে, বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভ‚ম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরীমল্ল রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এ পূজার প্রবর্তন করেন। সে পূজাপদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজা থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী দেবী সপরিবার বটে; কিন্তু লক্ষী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতীর স্থান বদল করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ লক্ষীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের রীতিকে জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও পূজিত হয় জগৎমল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি।

তাছাড়া মল্ল রাজবাড়ির পূজায় দেবীপটের যে ব্যবহার দেখা হয়, তা অনেকটাই স্বতন্ত্র প্রকৃতির। বাংলার সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না। এ পূজাও কংসনারায়ণ প্রবর্তিত পূজার অনেক আগে প্রচলন ছিল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন। সেও কংসনারায়ণের বহু আগের ইতিহাস।

সাহিত্যিক ও গবেষক