বাংলাদেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকিং দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখার আগেই আস্থার সংকটে পড়েছে ইসলামি ধারার ব্যাংকিং। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে এ ধারার ব্যাংকিং এখন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতেও ইসলামি ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হচ্ছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো। এ সেবার প্রতি গ্রাহকদের চাহিদা ও বেশি মুনাফার সুযোগ থাকায় ব্যাংকগুলো এদিকে ঝুঁকছে। কেউ পূর্ণাঙ্গ, কেউবা উইন্ডো খুলে সেবা দিচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে ইবিএল ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। সংকটের মধ্যে ইবিএল ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালু, গ্রাহকের সাড়া কেমন এবং পুরোপুরি শরিয়াহ মানা হচ্ছে কি নাÑনানা বিষয়ে শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেন ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ডেপুটি চিফ এ.কে.এম. মীজানুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোহান রাজিব
শেয়ার বিজ: মূলধারার ইসলামি ব্যাংকগুলো যখন ধুঁকছে, তখনই ইবিএল ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালু করল। এর কারণ কী?
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: মূলধারার ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সংকটের কারণ আমাদের সবারই জানা। যখন কোনো ব্যাংকের নগদ প্রবাহে ঘাটতি পড়ে, তখন ইসলামিক বা কনভেনশনাল সব ব্যাংকই বিপদে পড়ে। এখন নগদ প্রবাহের ঘাটতির নানা কারণ থাকতে পারে। আলোচ্য ব্যাংকগুলোয় বিনিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা না মানার কারণে তাদের অধিকাংশ বিনিয়োগই অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লিকুইডিটি সাপোর্ট নিতে হচ্ছে। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে নেতিবাচক রিপোর্ট আসছে। ফলে ব্যাংকগুলোয় আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, পুরো ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এখন সাধারণ মানুষ বিকল্প চাচ্ছে। যেখানে কষ্টার্জিত অর্থ রাখলে তা নষ্ট হবে না, শরিয়াহ পরিপালন করে যে আয় হবে তা শেয়ার হবে। এ ক্ষেত্রে ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিং একটি শক্তিশালী বিকল্প। কারণ ইবিএল পুরোদস্তুর একটি কমপ্লায়েন্ট ব্যাংক। মার্কেটে ব্যাংকটির ভালো সুনাম রয়েছে। তাছাড়া বিগত বছরগুলোয় ইবিএলের গ্রাহকরা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের জন্য অনেক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এমনও দেখা গেছে, ইসলামিক ব্যাংকিং চালু হবে এ আশায় অনেক গ্রাহক কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ে চলতি হিসেবে টাকা জমা করে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। কোনো কোনো গ্রাহক কনভেনশনাল থেকে ঋণের অনুমোদন নিয়েও টাকা তোলেননি। শুধু ইসলামিক ব্যাংকিং থেকে সেবা নেয়ার আশায়। ফলে বর্তমান মার্কেটের সার্বিক অবস্থা এবং ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা যাচাই-বাছাই করেই ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিং চালু করেছে।
শেয়ার বিজ: ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলোর ওপর মানুষের এখন আর আগের মতো আস্থা নেই। এমন পরিস্থিতিতে ইবিএল কীভাবে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক আনবে?
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: আস্থার সংকট আছে, আবার চাহিদাও আছে। সবগুলো ইসলামিক ব্যাংক আস্থার সংকটে ভুগছে না। আপনি যদি কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ের মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর প্রতি তাকান তাহলে দেখতে পাবেন তারা কিন্তু আস্থার সংকটে নেই। দু’একটি বড় ইসলামি ব্যাংক এখনও ভালো অবস্থায় আছে। মানুষের চাহিদা রয়েছে। তবে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং। গত জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে উইন্ডোভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার আমানতের ক্ষেত্রে ২৮.৮১ শতাংশ এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৪৬.৫০ শতাংশ। যেখানে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধির এই হার যথাক্রমে ৬.৭৬ ও ৯.৬২ শতাংশ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আস্থার পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। এভাবে আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে পারলে ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডোতে মানুষ আসবেই। ইবিএল যেহেতু দেশের অন্যতম টেকসই ও শক্তিশালী ব্যাংক এবং ইবিএলের প্রতি মানুষের যে প্রবল আস্থা, সেটা ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের প্রতিও থাকবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাছাড়া শরিয়াহ পরিপালনে ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে অঙ্গীকার সুস্পষ্ট। আমাদের প্রতিটি প্রোডাক্টেও নতুনত্ব আছে শরিয়াহ পরিপালনকে সামনে রেখেই। সুতরাং ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকরা আকৃষ্ট হবেন এ আশা আমরা করতেই পারি।
শেয়ার বিজ: অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় আপনারা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে আলাদা কি প্রোডাক্ট এনেছেন?
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিং বিনিয়োগ বা অর্থায়নের ক্ষেত্রে মুশারাকাকে গুরুত্ব দিচ্ছে যেটি পুরো বিশ্বের ইসলামিক ব্যাংকিং মার্কেটে অবহেলিত। আমরা ইতোমধ্যে চলতি মূলধন অর্থায়নে কনটিউনিউয়াস মুশারাকা প্রোডাক্ট চালু করেছি। ভালো কোম্পানি, হিসাব-নিকাশ রক্ষণাবেক্ষণে যাদের সুনাম রয়েছে, যাদের ভালো সফটওয়্যার রয়েছে তারা এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। পোস্ট এক্সপোর্ট ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রেও মুশারাকা এক্সপোর্ট ফাইন্যান্স চালু করেছি। মুশারাকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে বড় ইসলামিক ব্যাংকগুলোই প্রোডাক্ট চালু করতে সাহস পাচ্ছে না; কারণ এতে ক্ষতি বহন করার ঝুঁকি আছে। কিন্তু আমাদের সম্মানিত পরিচালনা পর্ষদ মুশারাকাভিত্তিক এ প্রোডাক্টগুলো অনুমোদন করেছেন। মুশারাকাভিত্তিক আরেকটি প্রোডাক্ট অতি শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে। যেটি হবে বাংলাদেশে একেবারেই প্রথম। তাছাড়া মুদারাবাভিত্তিক অর্থায়ন প্রোডাক্ট চালু করার পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।
শেয়ার বিজ: ইসলামিক ব্যাংকিং পরিচালনায় শরিয়াহ বিষয় পুরোপুরি মানা হচ্ছে কি না?
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: ইবিএল ইসলামিক ব্যাংকিং আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। কিন্তু প্রোডাক্ট, পলিসি, গাইডলাইন ইত্যাদি তৈরি শুরু হয় ২০২২ সালের শুরু থেকে। আমাদের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠিত হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে; যা কিছু প্রণীত হয়েছে তার সবই প্রথমে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটিতে অনুমোদন করানো হয়েছে, তারপর তা পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করেছে। আর কার্যক্রম শুরুর পর থেকে প্রতিটি কর্মকাণ্ড শরিয়াহ অনুমোদিত প্রোডাক্ট ও গাইডলাইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। এটি আমরা হলফ করে বলতে পারি শরিয়াহ শুধু কাগজে-কলমে নয়, অ্যাকাউন্টিং ও সফটও?য়্যারে পরিপালন আমরা নিশ্চিত করেছি। বাংলাদেশে আমরাই প্রথম মুরাবাহা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সফটওয়্যারের মধ্যে ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করেছি। কোথা থেকে মালামাল কেনা হলো, কত টাকার মালামাল কেনা হলো ইত্যাদি সব তথ্য ভাণ্ডার ম্যানেজমেন্টে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বায়িং এজেন্ট পলিসি এবং টেকওভার পলিসি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে; যা অনুসরণের মাধ্যমে শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত হবে। শরিয়াহ পরিপালনে ইবিএল ম্যানেজমেন্ট জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।
শেয়ার বিজ: সারাদেশে কতটি শাখায় ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে?
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: বর্তমানে সারাদেশে ইস্টার্ন ব্যাংকের ২০টি শাখায় ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকের অন্যান্য সব শাখায় ইসলামিক ব্যাংকিং হেল্পডেস্ক স্থাপনের মাধ্যমে অনলাইন ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
শেয়ার বিজ: ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: তেমন কোনো প্রচারণা ছাড়াই আমরা বিপুল সাড়া পাচ্ছি। শুরুর ২৫ দিনেই আমাদের ডিপোজিট ১০০ কোটি টাকায় উপনীত হয়েছে। বিনিয়োগও হয়েছে উল্লেখযোগ্য। আরও কিছু বিনিয়োগ পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন শেষে বিতরণের অপেক্ষায় আছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা একটি ভালো অবস্থানে পৌঁছাবো বলে আশা করছি।
শেয়ার বিজ: ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সবশেষ আর্থিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে চাই।
এ.কে.এম. মীজানুর রহমান: দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পরিস্থিতি দেখে আমি হতাশ। তবে আশাবাদী এ কারণে যে সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অন্যগুলোও চেষ্টা করছে। শরিয়াহ পরিপালনে ইসলামিক ব্যাংকগুলোকে কাগজ-কলমের পাশাপাশি প্রকৃত অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামিক ব্যাংকিং ইসলামিক ব্যাংকারদের হাতে থাকতে হবে। অন্যথায় বর্তমান দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।