নিজস্ব প্রতিবেদক: সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশের কে কত টাকা ‘পাচার করেছে’, সে তথ্য জানতে চেয়ে হাইকোর্ট আট মাস আগে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, পুলিশপ্রধান ছাড়া আর কোনো বিবাদী সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেননি। এমনকি এ-সংক্রান্ত রুলের জবাবও দেননি সেই বিবাদীরা। কেন তারা আদালতের নির্দেশে প্রতিবেদন বা রুলের জবাব দেননি, সে প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষ স্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেনি আদালতে।
পুলিশপ্রধানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, গতকাল সেটি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এসএম মজিবুর রহমানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক ওই প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন। রিটকারী পক্ষে আদালতে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিবেদন দেখে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জানতে চান, এ আদালত বিবাদীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হলফনামা করে প্রতিবেদন দিতে। কিন্তু পুলিশপ্রধান ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কেনো বিবাদী প্রতিবেদন দেননি কেন?
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা যোগাযোগ করছি। দীর্ঘদিন কভিড পরিস্থিতির কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল। তাদের (বিবাদীরা) কাজ করতে অসুবিধা হয়েছে। আমাদের যোগাযোগে অসুবিধা হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেব।’
সেজন্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারল এক মাসের সময় চাইলে আদালত আগামী ২১ নভেম্বর তারিখ রেখে ওই সময়ের মধ্যে হলফনামা করে প্রতিবেদন দিতে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বিবাদীদের নির্দেশ দেন।
বিদেশি ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস।
সুইস ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশি নাগরিকদের টাকা নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিটটি করেছিলেন এ দুই আইনজীবী।
সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেন। সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে, সে তথ্য জানতে চান হাইকোর্ট।
পুলিশপ্রধানের প্রতিবেদনে যা আছে
ঢাকা ও চট্টগ্রামে তদন্তাধীন সাত মামলায় বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৮ টাকা পাচারের তথ্য হাইকোর্টকে দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এসব ব্যক্তির মধ্যে আছেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর একেএম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদের নাম।
এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও দুবাইয়ে টাকা পাচার করেছেন বলে সিআইডির প্রতিবেদনে তথ্য দেয়া হয়েছে।
তালিকায় থাকা বাকিরা হলেনÑফরিদুপরের বোয়ালমারীর রাজীব হোসেন রানা, নেত্রকোনার বারহাট্টার জামাল, কুমিল্লার দাউদকান্দির শরিফুল ইসলাম ও আউলাদ হোসেন, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মো. শাহজাহান বাবলু, ফেনীর ছাগলনাইয়ার এনামুল হক, চট্টগ্রামের খুলশীর নাজমুল আবেদীন, সোহেল আবেদীন, পাহারতলী এলাকার একেএম জাহিদ হোসেনসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও চার-পাঁচজন।
এছাড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রামের এ অ্যান্ড বি আউটারওয়্যার অ্যান্ড নর্ম আউটফিট অ্যান্ড একসেসরিজ লিমিটেডের নাম রয়েছে।
সিআইডির এ প্রতিবেদনটিই পুলিশের মহাপরিদর্শক রাষ্ট্রপক্ষের মাধ্যমে আদালতে জমা দেন, যেটি গতকাল উপস্থাপন করা হয়।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় তিন ধাপে মোট আট কোটি ৮৩ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯৮ টাকা ‘পাচার’ করেছেন।
ফরিদপুরের রাজীব হোসেন রানা ও নেত্রকোণার বারহাট্টার জামাল সিঙ্গাপুরে ৮১ লাখ টাকা, কুমিল্লার দাউদকান্দির শরিফুল ইসলাম ও আউলাদ হোসেন ৮৩ লাখ টাকা, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও এনামুল হক ২৩ কোটি ২৩ লাখ ৭৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা এবং একেএম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদ দুই কোটি ২৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮২ হাজার ৩৫৯ টাকা পাচার করেছেন বলে সিআইডির ভাষ্য।
এছাড়া কুমিল্লার মো. শাহজাহান বাবলু ২১ লাখ এবং চট্টগ্রামের নাজমুল আবেদীন, সোহেল আবেদীন, একেএম জাহিদ হোসেন ও অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচজনসহ এ অ্যান্ড বি আউটারওয়্যার অ্যান্ড নর্ম আউটফিট অ্যান্ড একসেসরিজ লিমিটেড ৪০ কোটি ৮৫ লাখ ১০ হাজার টাকা পাচার করেছে বলে তথ্য দিয়েছে সিআইডি।
সেইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১০১ মিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য প্রতিবেদনে দিয়েছি সিআইডি।
এর মধ্যে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে ৩৪ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্ধারের কথাও সেখানে বলা হয়েছে।