মনোজিৎ মজুমদার: রহিমা বেগমের পরিবারে স্বামী, শাশুড়ি ও তিন সন্তানসহ সদস্য সংখ্যা ছয়জন। ভ্যানচালক স্বামীর একার উপার্জনে পরিবারের খরচ বহন করা খুবই কষ্টসাধ্য। নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে রহিমা চিন্তা করে পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনতে কিছু একটা করতে হবে। নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় ২০১২ সালে ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে রাজশাহীর বানেশ্বর এলাকায় নিজ বাড়ির সাথেই খালি জায়গায় একটি ছোট পোলট্রি খামার গড়ে তোলেন রহিমা। খামারটি বড় হতে থাকে এবং তিন বছরের মাথায় ব্যাংকঋণ পরিশোধ করে দেয়। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কভিড মহামারিতে তার খামারটি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সরকার ঘোষিত ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা পেয়ে রহিমার খামারটি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বর্তমানে রহিমার পোলট্রি খামারে মুরগির সংখ্যা দেড়
হাজারের ওপরে।
পোলট্রি শব্দটি ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘পোলে’ থেকে এসেছে। পোলট্রি শব্দের অর্থ এক ধরনের পোষা প্রাণী। যেমনÑমুরগি, টার্কি যাদের মাংস ও ডিমের জন্য পালন করা হয়। বিশ্বে সর্ব প্রথম পোলট্রি ধারণার সূত্রপাত হয় ১৯২৩ সালে আমেরিকায়। বাংলাদেশে ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পোলট্রি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। নব্বইয়ের দশকে তা গতিশীলতা লাভ করে।
পোলট্রি শিল্প কৃষিনির্ভর শিল্পের একটি উপখাত। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে পোলট্রি শিল্প। এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ষাট লাখ মানুষ। প্রাণী চিকিৎসক, পোলট্রি বিশেষজ্ঞ, নিউট্রিশনিস্টসহ আরও প্রায় এক লাখ মানুষ সরাসরি এ শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী। গার্মেন্টস শিল্পের পর নারীদের কর্মসংস্থানে বড় ভ‚মিকা রাখছে পোলট্রি শিল্প।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিতকরণে আমাদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মানবদেহে পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রাণিজ আমিষের ভ‚মিকা অপরিসীম। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস পোলট্রি ডিম ও মাংস যা, সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। এই পরিস্থিতিতে মানসম্মত খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এক অনবদ্য ভ‚মিকা রাখছে পোলট্রি শিল্প।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৭টির সঙ্গে পোলট্রি শিল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই শিল্পকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি শিল্পের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার ৪৫ শতাংশ আসে পোলট্রি শিল্প থেকে। এ শিল্পে বিনিয়োগ বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অপরদিকে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে প্রতিবছর এক শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি। এ বাস্তবতায় দেশে পোলট্রি শিল্প খাতে আরও আত্মকর্মসংস্থান এবং উৎপাদন বাড়ানোর অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। এটা নিশ্চিত করা গেলে গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষিত বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের অধিক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত কমবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য জুন, ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত পোলট্রি খামারের সংখ্যা ২ লাখ ৫ হাজার ২৩১টি। দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। দুধ উৎপাদন ৬১ লাখ টন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ টন। মাংসের উৎপাদন ৪৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৭ লাখ টন।
ডিমকে বলা হয় পরিপূর্ণ খাদ্য। বিশ্বে যে কয়টি খাদ্যকে সুপার-ফুড হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে ডিম সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মানুষের বছরে ন্যূনতম ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। তবে এর বেশি খেলেও ক্ষতি নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশে এখন জনপ্রতি বার্ষিক ডিমের প্রাপ্যতা ১৩৫টি।
সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২৪) প্রণয়ন করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে জনপ্রতি প্রতিদিন দুধ ও মাংস যথাক্রমে ২৭০ মিলি ও ১৫০ গ্রাম এবং ডিম বছরে ১৬৫টি ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদশে গড়ার লক্ষ্যে জনপ্রতি দুধ ও মাংস যথাক্রমে ৩০০ মিলি ও ১৬০ গ্রাম এবং ডিম বছরে ২০৮টি ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিম উৎপাদনের একটি প্রাক্কলন করেছে। সে হিসাব অনুযায়ী ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ডিমের বার্ষিক উৎপাদন হবে প্রায় ৩ হাজার ২৯৩ কোটি ৪০ লাখ কোটি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৪ হাজার ৬৪৮ কোটি ৮০ লাখট।
কভিড মহামারির পর রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে পোলট্রি খাদ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আমদানিকৃত খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে এ শিল্পের উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিপণন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ডিম ও মাংসের বাজার অস্থিতিশীল করছে। এ শিল্পের উন্নয়ন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোলট্রি শিল্পের সাথে যুক্ত সকল উপকরণ ও খাদ্যের ওপর থেকে শুল্ক মওকুফ করে এবং পোলট্রি মুরগির বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা বাড়াতে হবে। পোলট্রি মুরগির প্রধান খাদ্য ভুট্টা। দেশে ভুট্টার উৎপাদন বাড়াতে হবে। সিন্ডিকেট কঠোরভাবে দমন করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ভোক্তারা যাতে ডিম ও মাংস সাধ্যের মধ্যে কিনতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি খামারকে সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে, যাতে দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে সব খামারি সরকারি সুবিধা পেতে পারে।
নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দেশে যে কয়েকটি শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার মধ্যে পোলট্রি শিল্প অন্যতম। সরকার উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত যুবক, তরুণ-তরণীরা যাতে চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে পারে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে সে জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করেছে। সরকারি সহযোগিতা, উদ্যোক্তাদের পরিশ্রম, বিনিয়োগে উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ শিল্প আজ একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
অল্প পুঁজিতে স্বল্প জায়গায় গড়ে ওঠা এই পোলট্রি শিল্পই আজ বহু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। এই শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় অত্যন্ত মূল্যবান বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রহিমাদের মতো হাজার হাজার ক্ষুদ্র খামারির কারণেই দেশ ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে বিনিয়োগ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থান এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। নিশ্চিত হবে মানসম্মত পুষ্টির জোগান।
মুক্ত লেখক