পৃথিবীর ফ্রিল্যান্সার ১৪ শতাংশইএখন বাংলাদেশে

আবুল কাসেম হায়দার: বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থানের কারণে অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের সময় আমাদের একমাত্র রপ্তানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এখন আমাদের প্রধানতম রপ্তানি হচ্ছে তৈরি পোশাক। দ্বিতীয় পণ্য হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। পাট ও পাটজাত পণ্য আর তার আগের স্থানে নেই। নতুন রপ্তানি খাত হিসেবে এগিয়ে এসেছে আইসিটি খাত তথা তথ্যপ্রযুক্তি খাত।

বিশ্বের ১৫৭ কোটি মানুষ ফ্রিল্যান্সিং করেন। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ৩৫ বছর বা তার নিচে।

ফ্রিল্যান্সিং খাতের উত্থান: দেশের যুবসমাজ নানা খাতে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সরদের নীরব বিপ্লব ঘটেছে। শহর, গ্রাম সর্বত্র তরুণ-তরুণীরা ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে কয়েক হাজার ডলার উপার্জন করছেন। বর্তমান বিশ্বের ফ্রিল্যান্সিং এর ১৪ শতাংশই বাংলাদেশে। তারা দেশে বসে অনলাইনে বিভিন্ন কাজ করেন।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড রিপোর্ট ২০২৩ বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতের নানা উন্নয়নের বর্ণনা এসেছে। ‘বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন আকার’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক নানা সংকটের মধ্যেও ব্যবসাবাণিজ্যকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তার জন্য ডিজিটাল মাধ্যমই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়।

ডব্লিউটিও এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নানা উন্নয়নের বর্ণনা এসেছে। কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে আইটি খাত এগিয়ে এসেছে। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারত তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে প্রচুর মার্কিন ডলার আয় করছে। বাংলাদেশেও ভারতের আইটি খাতের উত্থানের সুবাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করেছে।

মুক্ত পেশাজীবী : ফ্রিল্যান্সিংয়ের বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘মুক্ত পেশাজীবী’। এ পেশার সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সকাল নয়টা-ছয়টার অফিসে এই পেশায় আটকে থাকতে হয় না। অফিস, বাসা বা যে কোনো স্থানে বসেই কাজ করতে পারেন ফ্রিল্যান্সাররা। এ জন্য প্রয়োজন হয় দক্ষতা, বিদ্যুৎ আর গতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মীর মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কিছু কাজ করালে তাতে খরচ বেশি হয়। আবার অনেক সময় চাহিদামতো কর্মী ও পাওয়া যায় না। তারা তখন বাহিরে থেকে (আউট সোর্সিং) নির্দিষ্ট কাজটি করিয়ে দেন। এতে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি যে কোনো স্থান থেকে কাজটি করে ওই ব্যক্তিও আয় করেন।

ফ্রিল্যান্সার দেশে কত: বেশির ভাগ কাজ পাওয়া কিছু ওয়েবসাইটে তথ্যপ্রযুক্তি ভাষায় এগুলো হচ্ছে ‘অনলাইন মার্কেট প্লেস’ দেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি যুব সমাজের আগ্রহ বাড়ছে।

বাংলাদেশে কতসংখ্যক মুক্ত পেশাজীবী আছেন, তার নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনেও এ-সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেট প্লেসে কাজ করা হয়। সেই গুলি হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে ফ্রিল্যান্সার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।

উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে সহায়তা প্রদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এক্সপ্লেডিং টগিকসের তথ্যানুযায়ী বিশ্বের ১৫৭ কোটি মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে ৩৫ বছর বয়সের মানুষ প্রায়  ৭০ শতাংশের মতো। ওয়েব ডিজাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের চাহিদা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। প্রতি ঘণ্টায় তারা গড়ে আয় করে ২১ মার্কিন ডলার। যদিও পে ওনার ফ্রিল্যান্স ইনকাম সার্ভে রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী তখন প্রতি ঘণ্টায় ফ্রিল্যান্সারগণ গড়ে ২৮ ডলার করে আয় করেন।

অগ্রগতি কতটুকু: বাংলাদেশের মুক্ত পেশাজীবীরা খুব কম মজুরিতে কাজ করেন। আমাদের এখন বেশি মজুরির কাজে অগ্রসর হতে হবে। সে জন্য যিনি যে বিষয়ে পড়াশোনা করবেন তিনি সেই বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করবেন বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১১টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করা হয়। অথচ ১ হাজার ২৩টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করার সুযোগ রয়েছে।

ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করা সম্ভব। এই জন্য কোনো অফিসের প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে অনলাইনে প্রযুক্তি শিখেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য নিজকে যোগ্য করে গড়ে তোলা খুবই সহজ।

ডিজিটাল সেবা রপ্তানি: ডব্লিউটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ডিজিটাল সেবা খাতে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে রয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে গড়ে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তার বিপরীতে ডিজিটাল সেবা রপ্তানীতে গড় প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ। ই-কমার্স ব্যবসায় প্রতি বছর গড়ে ১৮ শতাংশের মতো হচ্ছে। ২০২১ সালে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ দ্রুতগতি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। প্রত্যন্ত এলাকায় ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) দেয়া তথ্য অনুযায়ী ডঞঙ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তির খাতের ৪০০ প্রতিষ্ঠান ৮০টি দেশে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলারের ডিজিটাল সেবা রপ্তানি করেছে। ২০২২ সালে রপ্তানি রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার ১৬৭টি গন্তব্যে। বর্তমান দেশে ডিজিটাল আইটি খাতের অবদান ১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ খাতে সরাসরি ৩ লাখের অধিক মানুষ জড়িত। ২০২৫ সালের মধ্যে তা দাঁড়াবে প্রায় ৫ লাখের অধিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী কনসালট্যান্সি সার্ভিস, নন-কাস্টমাইজ কম্পিউটার সফটওয়্যার, ডেটা এসেসিং ও হোস্টিং সার্ভিস কম্পিউটার মেরামতসহ বিভিন্ন সেবা রপ্তানিতে চার বছরের ব্যবধানে দেড় গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের অধিক কম্পিউটার সংক্রান্ত সেবা রপ্তানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ কোটি ৩৭ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। বিদায়ী অর্থবছর ২০২২-২৩ কম্পিউটার সংক্রান্ত সেবা রপ্তানি বেড়ে ৫৫ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

যত্নশীল হওয়া দরকার: ফ্রিল্যান্সার সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্ব অনেক বেশি। সরকারকে এই জন্য আরও বেশি পরিকল্পিত, বলিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকমানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে সরকারের কিছু কিছু উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সার সংখ্যা ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি একটি খুবই ভালো সংবাদ। আরও বেশি ভালো হবে, যখন আমরা শুনব তৈরি পোশাক শিল্পের মতো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ৮০ শতাংশই আইটি খাত থেকে আসবে। এই জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেমনÑ

এক. শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যাবে না। আমাদের শিক্ষার মানের ও কৌশলের পরিবর্তন আনতে হবে। তাই শিক্ষানীতি আরও আধুনিক এবং সময়োপযোগী করতে হবে;

দুই. কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে কমপক্ষে ৪টি করে টেকনিক্যাল স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি, দশম শ্রেণি পাসের পর যাতে মেধানুযায়ী ছাত্রছাত্রীরা টেকনিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য অনুমোদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা দরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী একটি অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু উদ্যোক্তারা ভুল ধারা অনুসরণ করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে এগিয়ে আসছে। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন করতে হবে;

তিন. আইটি খাতের উপকরণের মূল্য কমের জন্য সরকারকে কর, ভ্যাট ও অগ্রিম কর আদায় হ্রাস করতে হবে। এখন আইটি খাতের উপকরণের মুল্য অনেক বেশি। স্বল্প ও কম আয়ের জনগণ আইটি ব্যবহারে কঠিন হয়ে পড়ছে। ফ্রিল্যান্সিং খাতের উত্থানের জন্য খরচ কমানোর কোনো বিকল্প নেই;

চার. বর্তমানে বাংলাদেশে মাত্র ১১টি খাতে ফ্রিল্যান্সিং করে। অথচ খাত রয়েছে ১ হাজার ২৩টি। আমাদের খাত বাড়াতে হবে। তাই প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। চাই সরকারের উৎসাহ। চাই সরকারের প্রণোদনা; পাঁচ. আমাদের বিপুল তরুণ জনশক্তি রয়েছে, যারা ফ্রিল্যান্সিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হতে পারেন। এই জন্য প্রয়োজন দেশ সুস্থ ধারার রাজনীতি। জাতীয় নির্বাচনসহ সব পর্যায়ে নির্বাচনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গ্রহণযোগ্য বড়ই প্রয়োজন। যুব সমাজের আস্থাভাজন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে পরিচালনার সরকার না হলে তাদের মনের আশা কখনও পূরণ হবে না। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত সব দলের, সব মানুষের অংশগ্রহণমূলক। হওয়া উচিত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে। রাজনৈতিক সমস্যা সুষ্ঠ রাজনৈতিক সমাধান না হলে ফ্রিল্যান্সিংসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

আইএফআইএল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও  আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

aqhaider@youthgroupbd.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০