রহমত রহমান: আমদানি করা এলএনজির চালানের বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয় না। পরিশোধ করা হয় না প্রযোজ্য শুল্ককর। মাত্র এক বছরে রাজস্ব বকেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৬২৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। বকেয়া পরিশোধ আর বিল অব এন্ট্রি দাখিলের জন্য বারবার চিঠি দেয়া হয়। এমনকি বকেয়া আদায়ে বকেয়া আদায়ে ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করা হবে বলে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করা হয় না। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) বিরুদ্ধে বকেয়া পরিশোধ না করার এমন অভিযোগ উঠেছে। তবে বকেয়া আদায়ে এবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে এনবিআরের দিকনির্দেশনা চেয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে সম্প্রতি চিঠি দেয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ এই বকেয়ার কারণে কাস্টম হাউসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত এবং ফিসক্যাল ডিসিপ্লিন ও শুল্ক আনুষ্ঠানিকতার শৃঙ্খলা বিঘœ হচ্ছে বলে এনবিআরকে জানানো হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বকেয়া শুল্ককর পরিশোধের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ডিসেম্বর মাসে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, পেট্রোবাংলার আমদানি করা এলএনজি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ায় গ্যাস পরিবহনকারী কার্গো জাহাজ থেকে মহেশখালীতে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালের এফএসআরইউ’তে এলএনজি আনলোড করা হয়। এই ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরাসরি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কাস্টমস আইনের ৭৯(এ) ধারা অনুযায়ী ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রেরিত বিল অব এন্ট্রি এবং এনবিআরের ২০০১ সালের এক আদেশ অনুযায়ী বিল অব এন্ট্রিসহ আনুষঙ্গিক দলিলাদি সংশ্লিষ্ট কমিশনারে দাখিল করতে হয়। সে অনুযায়ী পণ্য শুল্কায়ন ও শুল্ককর পরিশোধ করে খালাসের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু পেট্রোবাংলার পণ্যচালান আমদানি হওয়ার ছয় মাস পরে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি, যা কাস্টমস আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কাস্টম হাউসের হিসাব অনুযায়ী, পেট্রোবাংলার কাছে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত শুল্ককর বকেয়া পড়েছে পাঁচ হাজার ৬২৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আইন লঙ্ঘন করায় রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের কাছে এই বকেয়া জমা পড়েছে। দেখা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত পেন্ডিং বিল অব এন্ট্রির সংখ্যা ৫৯টি, যাতে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ তিন হাজার ৮৭৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দুটি পেন্ডিং বিল অব এন্ট্রিতে বকেয়া ১২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১৪টি বিল অব এন্ট্রিতে ৭৫৮ কোটি আট লাখ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৯৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, মার্চে পাঁচটিতে ২৩২ কোটি ৮১ লাখ টাকা, মে মাসে ১০টিতে ৪৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, জুনে ১৫টিতে এক হাজার ৩৮৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, জুলাইয়ে একটিতে ৪৭ কোটি তিন লাখ টাকা ও আগস্টে ১০টি বিল অব এন্ট্রিতে বকেয়া ৭৭১ কোটি এক লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যেসব আইজিএমের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি, এমন আইজিএমের সংখ্যা ৩৫টি। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ হিসাব করা হয় প্রায় এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
কাস্টম হাউস সূত্রমতে, কাস্টম হাউস থেকে পেট্রোবাংলাকে ১০ বার চিঠি দেয়া হয়। এছাড়া টেলিফোনে একাধিকবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে কোনো বকেয়া পরিশোধ করেনি পট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ। ২০ জুন আমদানিকারক পেট্রোবাংলাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়, কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি। ২৬ জুন আবার চিঠি দেয়া হয়, যাতে বলা হয়, বকেয়া পরিশোধ ও আইনের পরিপালন করা না হলে কাস্টমস আইন ও মূসক আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের বিন লক, পণ্য খালাস বন্ধ ও ব্যাংক হিসাবের লেনদেন কার্যক্রম অপরিচালন করা হবে। এরপরও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বকেয়া পরিশোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে ৭ জুলাই ও ২১ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলা থেকে চিঠির মাধ্যমে কাস্টম হাউসকে জানানো হয় যে, অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকি প্রাপ্তি সাপেক্ষে এলএনজি আমদানি পর্যায়ে বকেয়া শুল্ককর পরিশোধ করা হবে।
কাস্টম হাউসের চিঠিতে বলা হয়, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে এই পণ্যের ‘রিকন্সিলাশন’ ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি দপ্তরের আইন নিয়মনীতি পরিপালনে দায়িত্বশীল হওয়া সমীচীন। রাজস্ব পরিশোধে এনবিআর থেকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলাকে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি আইজিএমের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করেই পণ্যের হোম কনজাম্পশন কাস্টমস আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সেজন্য নির্ধারিত সময়ে বিল অব এন্ট্রি দাখিল ও কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য পেট্রোবাংলাকে বাধ্য করতে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করা যেতে পারে বলে কাস্টম হাউস মনে করে। পাশাপাশি বকেয়া আদায়ে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার বিষয়েও এনবিআরের দিকনির্দেশনা কামনা করা হয় চিঠিতে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বকেয়া আদায়ে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করতে অনুমতি চেয়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবহিত নই। আমি চেক করে দেখি। সরকারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার অ্যাকাউন্টগুলো সবই রাষ্ট্রের জরুরি কাজ করে, যেটা তাদের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফ্রিজ হওয়ার কারণে যদি পেট্রোবাংলার কার্যক্রম ব্যাহৃত হয়, সেটা রাষ্ট্র দেখবে। আমি যেহেতু জানি না, চেক করে দেখি।’