পেনিনসুলা গার্মেন্টসের রাজস্ব ফাঁকি ৩৮ কোটি টাকা

সাইদুর রহমান, চট্টগ্রাম: এক সময়ের আলোচিত ব্যবসায়ী মেজর (অব.) এম এ মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মেসার্স পেনিনসুলা গার্মেন্টস লিমিটেড। চট্টগ্রাম ইপিজেডের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটে শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার বার্ষিক নিরীক্ষা না করায় সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটির ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের নিরীক্ষা করে। তাতে এসব তথ্য উঠে আসে।

প্রতিষ্ঠানটির গত পাঁচ বছরের নিরীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট তিনটি কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে। যার বিপরীতে আবার বিভিন্ন অঙ্কে মোট ৩৭ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৬৯২ টাকা দাবিনামা দেয়া হয়েছে।

এসব নোটিশের মধ্যে একটিতে বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত পণ্য অবৈধভাবে অপসারণ করে তিন কোটি ৪১ লাখ নয় হাজার ৪৩৮ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তোলা হয়েছে। ওই নোটিশে বন্ড কমিশনারেট বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বেপজার ওয়েব সাইটের প্রাপ্ত তথ্য ও অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত আমদানি-রপ্তানির তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ৪৭টি কাস্টম ক্লিয়ারেন্স ইস্যু হলেও গেট পাস নেয়নি পেনিনসুলা গার্মেন্টস। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যগুলো আমদানি করা হয়েছে তাদের ইএক্সপি নম্বর দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে চেক করে দেখা যায়, ব্যাংকের পিআরসি রিয়ালাইজড হয়েছে। এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট যে কস্টিম ক্লিয়ারেন্স গ্রহণ করে বেপজার গেট পাস গ্রহণ না করে ইপিজেডের অভ্যন্তরে প্রেবেশ না করে ৪৭টি আইপি ব্যবহার করে পণ্য অপসারণ করেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ইপিজেডের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে অবৈধভাবে অপসারণ বা খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি করে দিয়েছে। এসব পণ্যে আমদানিমূল্য তিন কোটি ৯২ লাখ ৯০ হাজার ৬৫ টাকার; যার বিপরীতে শুল্ক আসে তিন কোটি ৪১ লাখ নয় হাজার ৪৩৮ টাকা।

দ্বিতীয় নোটিশে কম আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ৪৯ হাজর ৩৪৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তোলা হয়েছে। ওই নোটিশে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা মেয়াদে বেপজা থেকে ৬০টি আইপি গ্রহণ করলেও ওই আইপির বিপরীতে সম্পূর্ণ পণ্য আমদানি হয়নি। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ছয় কোটি ১৬ লাখ ৩২ হাজার ৮২৯ টাকার কম পণ্য আমদানি করেছে। যার বিপরীতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

তারপর তৃতীয় নোটিশে বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল (ফেব্রিক্স অ্যান্ড এক্সেসরিজ) অবৈধ অপসারণ ও মজুতকৃত বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ কাঁচামাল রাখার অভিযোগ উঠেছে। যার মাধ্যমে ২৮ কোটি ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৯১১ টাকা রাজস্ব ফাঁকির দিয়েছে পেনেনসুলা গার্মেন্টস লিমিটেড। ওই নোটিশে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট বলেন, ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির গার্বেজের পরিমাণ এক লাখ ৮১ হাজার ৪০০ কেজি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির মোট গ্রসওয়েট ২০ লাখ ৯১ হাজার ৪২২ কেজি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে গার্বেজের তুলনায় শতকারা হার দাঁড়ায় প্রায় আট দশমিক ৬২ শতাংশ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তাদের হিসেবে দশ শতাংশ হারে কাঁচামাল ব্যবহার দেখিয়েছে।

এছাড়া ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা য়ায়, প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় লখ ৯৪ হাজার ৮৮০ কেজি পণ্য থাকার কথা থাকলেও মাত্র এক হাজার ১৬৫ কেজি কাঁচামাল পাওয়া যায়। যার ইতোমধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠনটি ছয় লাখ ৯৩ হাজার ৭১৫ কেজি কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। যার আমদানিমূল্য ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭৭০ মার্কিন ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩১ কোটি ৯৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩২৭ টাকা। যার বিপরীতে ২৮ কোটি ৫২ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৭ টাকা রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে। এছাড়া এক হাজার ১৬৫ কেজি মজুতকৃত কাঁচামালের ওপর শুল্ক ফাঁকি হয়েছে আট লাখ ৪৪ হাজার ১৬৪ টাকা।

এ বিষয়ে মেসার্স পেনেনসুলা গার্মেন্টস লিমিটেডের কমার্শিয়াল ম্যানেজার রুপন দে শেয়ার বিজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে (২০১৮ থেকে) গার্মেন্টসের কমপ্লাইন্স এবং করোনা পরিস্থিতিসহ নানা জটিলতায় আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যে কারণে পুরোনো লোকবল প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট থেকে আমাদের একধিকবার নিরীক্ষা করার জন্য চিঠি দিলেও আমরা তাদের সতায়তা করতে পারিনি। তারপর বন্ড কমিশনারেট নিজ উদ্যোগে ২০২১ সালে নিরীক্ষা করে এবং চলতি বছরের জুন মাসে তিনটি কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে। তবে আমরা ইতোমধ্যে পুরোনো লোকবলের সহায়তা নিয়ে মূল্যবান দলিলাদিগুলো সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছি এবং বন্ড কমিশনারেটের বেধে দেয়া ৩০ দিনের মধ্যে উত্তর দিয়েছি। বর্তমানে বন্ড কমিশনারেট থেকে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনার শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ দিন ধরে বার্ষিক নিরীক্ষা না করায় ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটির চার বছরের নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। তাতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার তথ্য উঠে আসে, যা বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সি বিধিমালা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং লাইসেন্স বাতিলযোগ্য। তাই চলতি বছরের জুন মাসে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো জারি করা হয়। এখনও উল্লেখিত অগ্রগতি হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়েছে।   

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০