দায়দেনা ও লোকসানে মৃতপ্রায় কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড। যদিও এক সময় দেশের কাগজের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করত এ কোম্পানি। তবে পুরোনো ও অকেজো যন্ত্রপাতি আর অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় এখন ডুবছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ কাগজকলটি। কোম্পানিটির বর্তমান চিত্র, লোকসানের কারণ ও উত্তরণ পরিকল্পনা নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের শেষ পর্ব ছাপা হচ্ছে আজ
মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী পেপার মিল লিমিটেড (কেপিএম) ৭০ বছরের পুরোনো, যা এখন মৃতপ্রায়। এ পুরোনো মিল বন্ধ হোক, তা চায় না সরকার। বরং এ মিলকে আবার সক্রিয় করতে চায় সরকার। এজন্য এ মিলের সংস্কার করা ছাড়াও নতুনভাবে আধুনিকায়নের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অন্যদিকে সংস্কারের চেয়েও মিলের নতুন রূপ তৈরির চেষ্টার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনামতে, কেপিএম বাঁচাতে প্রয়োজন আট হাজার কোটি টাকা। এ অর্থে দুটি মিল চালু করা হবে। আর শ্রমিকদের মতে, উৎপাদন বাড়াতে ও লোকসান কমাতে হলে মিলের তিনটি মেশিনই সার্বক্ষণিকভাবে চালু রাখতে হবে।
জানা যায়, মিলের লোকসান কমানোর জন্য ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এগুলো হলোÑঅধিকালের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করানো; কারখানার চাহিদা অনুযায়ী কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্থানে কাজে নিয়োজিত করা; যুগোপযোগী ফার্নিসের মাধ্যমে কাগজ উৎপাদন করা; কাঁচামাল হ্যান্ডলিংয়ের কাজ ঠিকাদারের পরিবর্তে অস্থায়ী শ্রমিক দ্বারা সম্পাদন করা; অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা; উচ্চ বেতনধারী জনবলের স্থলে কম বেতনধারী জনবল প্রতিস্থাপন।
গত ১৫ জানুয়ারি কেপিএম পরিদর্শন করেছেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। এ সময় প্রতিমন্ত্রীর কাছে মিলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে মিলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। স্বল্পমেয়াদি এ পরিকল্পনায় রয়েছে, কার্যপরিধির আলোকে কারখানাটি সীমিত আকারে চালু রাখার জন্য মিলের উৎপাদন সচল রাখা এবং নতুন মিল উৎপাদনে না যাওয়া পর্যন্ত মিলের অতি জরুরি অংশের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিস্থাপন করা। এ খাতে প্রায় ৬২ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
মধ্যমেয়াদি প্রকল্পের আওতায় রয়েছে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) মাধ্যমে বর্তমান মিলের আদলে দৈনিক ১০০ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইন্টিগ্রেটেড পাল্প পেপার মিল স্থাপন। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে আনুমানিক চার-পাঁচ বছর সময় লাগবে। এতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় রয়েছে, কাগজের চাহিদা বৃদ্ধি ও বাস্তবতার আলোকে দৈনিক ৩০০ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন পিএলসি, ডিসিএস, কিউসিএস (কোয়ালিটি কন্ট্রোল সিস্টেম) প্রভৃতি সম্পন্ন নতুন ইন্টিগ্রেটেড পাল্প পেপার মিল স্থাপন করা। এটি বাস্তবায়নে প্রায় ১০-১৫ বছর সময় এবং প্রয়োজন হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকার।
কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এমএমএ কাদের শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা লোকসান কমিয়ে এনেছি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মিল চালিয়ে রাখতে হলে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও নতুন মিল করার প্রয়োজন আছে। সেজন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় মিলটা চালিয়ে রাখলেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় আমরা দুটি নতুন মিল করার প্রস্তাব করেছি। বর্তমানে দুটি ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) তৈরির কাজ চলছে। একটি ছোট মিল প্রতি দিন ১০০ মেট্রিক টন হিসেবে বছরে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং আরেকটি বড় মিল যেটা বছরে এক লাখ থেকে দেড় লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।’
সূত্রমতে, এ মিলকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন-উপযোগী করার জন্য জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সের সঙ্গে কথা বলছে সরকার। তারা যদি কাজ করতে না চায়, তাহলে শিল্প মন্ত্রণালয়ই এ মিলের আধুনিকায়ন করবে। তবে চীন থেকে আর কোনো যন্ত্র আনতে চায় না মন্ত্রণালয়। আর কোনো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতেও রাজি নয় মন্ত্রণালয়।
মিলসংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘ঢাকায় বসে অনেক কিছুই পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকায় বসেই সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব হবে না।’
এদিকে মিল পরিদর্শনে গিয়ে অবৈধ দখলে থাকা কারখানাটির জায়গা উদ্ধারে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার।
কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অংশ সেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা চাই, এই মিলটা বেঁচে থাকুক। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক একগুঁয়ে স্বভাবের। তার এ ধরনের আচরণ দিয়ে এ মিল টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই মিলকে বাঁচাতে হলে শ্রমিকবান্ধব ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রয়োজন, শ্রমিকবান্ধব কর্মকর্তা প্রয়োজন।’