Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:44 am

পোলট্রি হ্যাচারিতে সফলতা

ইনকিউবিটরের পাল্লা খুললেই প্রাণের স্পন্দন। কিচিরমিচির শব্দে মুখর চারদিক। ডিমের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসছে মুরগির বাচ্চারা। নাটোরের সফল নারী উদ্যোক্তা হোসনে আরার পোলট্রি হ্যাচারিতে জš§ নেওয়া এ মুরগির বাচ্চারা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। ১০ বছরের এ কর্মযজ্ঞে তিনি তৈরি করতে পেরেছেন অনেক নারী উদ্যোক্তা।
নাটোরের রানী ভবানী রাজবাড়ীর লেকের উত্তরে চৌকিরপাড় এলাকায় হোসনে আরা গড়ে তুলেছেন জিশান পোলট্রি হ্যাচারি, যা নাটোরের পাঁচটি পোলট্রি হ্যাচারির মধ্যে সবচেয়ে বড়। হ্যাচারির ইনকিউবেটরের স্যাটার অংশের ৯টি কম্পার্টমেন্টে ট্রেতে করে সাজানো হয় শত শত ডিম। ৩৭ দশমিক ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় এখানে ডিমের অবস্থান থাকে ১৮ দিন। এরপর ডিমগুলোকে স্থানান্তর করা হয় ইনকিউবেটরের হ্যাচার অংশের ট্রেতে। হ্যাচারে ৩৭ দশমিক ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তিন দিনে ডিমের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে মুরগির বাচ্চা।
হ্যাচারিতে ডিম সরবরাহের জন্য আছে সাড়ে ১১ হাজার ধারণক্ষমতার দুটি সোনালি মুরগির খামার। গুণগতমানের ডিম সরবরাহের জন্য আছে যৌথ উদ্যোগের আরও কয়েকটি মুরগির খামার। জš§ নেওয়া মুরগির বাচ্চাদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাঁশের ঝুঁড়িতে করে সরবরাহ করতে হয়। নাটোর ছাড়াও রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহের খামারিরা এর ক্রেতা।
প্রতিটি বাচ্চার দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে মুনাফার পরিমাণ কম নয়। নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাজার এলাকার ব্যবসায়ী দৌলত হোসেন নান্টু ১৯ টাকা দরে আট হাজার মুরগির বাচ্চা কিনেছেন। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ হ্যাচারির বাচ্চাগুলোর মান ভালো, অসুখ-বিসুখ কম, তাই ঝুঁকি কম। দীর্ঘদিন ধরে আমি নিয়মিত বাচ্চা নিয়ে এলাকার খামারিদের মাঝে সরবরাহ করে আসছি।
হোসনে আরার এ সফলতা একদিনে আসেনি। অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন এ সফলতা। ১০ বছর আগে শুরু করেছিলেন পোলট্রি হ্যাচারি। তারও ১০ বছর আগে পোলট্রি খামার গড়ে তুলেছিলেন। আলাপচারিতায় হোসনে আরা ফিরে গেলেন দুই দশক আগে। বললেন, সখের বশে মাত্র ১০টা মুরগি পালন করেছিলাম। এরপর ধাপে ধাপে বাড়িয়েছি মুরগির সংখ্যা। বর্তমানে স্বামী-সন্তানরা আমার সঙ্গে কাজ করছেন। অবশ্য শুরুতে তাদের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। স্বামী হাফেজ লুৎফর রহমান জানান, একবার খামার ভেঙেও দিয়েছিলাম! কিন্তু ভেঙে পড়েননি হোসনে আরা। হার না মানার কারণে দুই দশক পরে স্পর্শ করতে পেরেছেন সমৃদ্ধির মাইলফলক।
বস্ত্র ব্যবসায়ী স্বামীর সংসারে অভাব-অনটন না থাকলেও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। চার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হোসেনে আরা। তাই মুরগির খামারের পরিধি বাড়িয়েছেন তিল তিল করে। এক সময় হাল ধরেছেন পুরো সংসারের। চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে জিশান আইন বিষয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করে মায়ের হ্যাচারি দেখাশোনা করছেন। মেজ ছেলে ইমরান বিসিএস ননক্যাডার সার্ভিসে চাকরি পেয়েছেন। সেজ ছেলে নাঈম পটুয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। ছোট ছেলে তানভির ওআইসি পরিচালিত আইওটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিপলইতে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখা করছেন। আমাদের সফলতার প্রেরণার উৎস আমাদের মমতাময়ী মা, এমনই জানালেন চার ছেলে।
হোসনে আরা যে শুধু নিজের ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন তা নয়, খামার ও হ্যাচারিতে তৈরি হয়েছে স্থায়ী এবং খণ্ডকালীন প্রায় ৩০ জনের কর্মসংস্থান। তিনি তৈরি করেছেন, অনেক নারী উদ্যোক্তা। এ উদ্যোক্তারা খামার স্থাপন করে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। এর মধ্যে ঘোড়াগাছা এলাকার খামারি সাজেদা বললেন, হোসনে আরা আপা আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন, আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।
নাটোরের ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রায় ১০০ নারী উদ্যোক্তার ব্যাংক ঋণের গ্যারান্টার হয়েছেন হোসনে আরা। মাত্র পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকার দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ঋণ পেয়েছেন তারা। ঋণগ্রহীতা মর্জিনা বলেন, আপা গ্যারান্টার হওয়ায় ব্যাংক ঋণ পেয়েছি। ঋণের টাকায় খামার করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি।
নাটোর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সেলিম উদ্দিন জানান, সততা, অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যবসায় হোসনে আরাকে সফল করে তুলেছে। তিনি আজ নাটোর জেলার সবচেয়ে বড় পোলট্রি হ্যাচারির মালিক। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তার কার্যক্রম সবার জন্য অনুকরণীয় বলে জানালেন এ কর্মকর্তা।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন হ্যাচারি পরিদর্শন করে বলেন, সবার আশীর্বাদে তিনি পৌঁছে যাবেন তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। লক্ষ্য সম্পর্কে হোসনে আরা বলেন, এখনও অনেক দূরে যেতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগি পালনে সফল হওয়ার চেষ্টা করছি। দেশ ও জাতিকে নিরাপদ মাংস উপহার দেওয়ার পাশাপাশি রফতানির ইচ্ছে রয়েছে তার।

এমএম আরিফুল ইসলাম