নিজস্ব প্রতিবেদক : পোশাক খাতে শ্রমিকদের নিরাপদ ও নারীবান্ধব কর্মপরিবেশের বিষয়টি এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মজুরি, নিরাপত্তা, ছুটি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মক্ষেত্রে আচরণ ও ক্ষতিপূরণের মতো বিষয় নিয়ে সমস্যায় পড়ছেন শ্রমিকরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার প্রেসক্লাবে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘নারীবান্ধব ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ সম্মিলন’Ñএ কথা বলেন গবেষক, শ্রমিক নেতা, উন্নয়নকর্মী ও সাধারণ শ্রমিকরা।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ‘সবার হোক অঙ্গীকার নিরাপদ ও নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ার’ স্লোগান নিয়ে এই আয়োজন করে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। উদ্দেশ্য নারীবান্ধব ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা।
আলোচকরা বলেন, প্রধান রফতানি খাত আর বিশাল সস্তা শ্রমবাজারের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সারা বিশ্বে খুবই পরিচিত। কিন্তু তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনার কারণে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্রে বিশ্বে নজির হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। নিহত শত শত মানুষ, আহত শ্রমিক ও নিঃস্ব পরিবারের হাহাকার পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার সামনে নিয়ে আসছে। যদিও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র শ্রমিকদের আইনগত অধিকার।
অনুষ্ঠানে কথা বলেন তাজরীন দুর্ঘটনার শিকার আহত শ্রমিক সবিতা রানী। তিনি বলেন, ‘২৪ নভেম্বর তাজরীনের তৃতীয় তলায় কাজ করছিলাম। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফায়ার অ্যালার্ম বাজা সত্ত্বেও কাজ চলছিল। আগুন লাগার পর নিচে এসে দেখি গেটে তালা দেওয়া। আগুন থেকে বাঁচতে ওপরে উঠতে অনেকের পায়ের নিচে পরলাম। মনে হচ্ছিল মারা যাচ্ছি। একটা ছেলের শার্ট ধরে কোনোভাবে প্রাণে বেঁচেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি মৃত জীবনযাপন করছি। শুয়ে শুয়ে দিন কাটে আমার। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না। তিনটা মেয়েসহ আটজনের সংসার নিয়ে অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ। আমি চলতে পারি না। কোনো কাজ করতে পারি না। আমার দায়িত্ব কে নেবে? আমার তিন মেয়েকে পড়াতে পারছি না।’
মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, দেশে আইন ও নিয়ম থাকলেও মালিকরা মানেন না। আবার যেসব মালিক শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিচার হচ্ছে না। ফলে নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় যারা কাজ করছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।’
আলোচকরা বলেন, গুণগত মানের দিক থেকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও কারখানার অভ্যন্তরে ও কারখানায় যাতায়াতের পথে নারী শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। কর্মক্ষেত্রে এখনও নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তাজরীন বা রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো এখনও শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা, নিরাপদে কাজ করতে পারেন না। হয়রানির শিকার হন। অভিযোগ করে সমাধান না পাওয়ায় এখন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক নারী শ্রমিক।’
আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বলেন, ‘কারখানার একজন শ্রমিক স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পান না। ঘরে ভালো খাবার পান না। নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এজন্য শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দরকার।’
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কয়েকটি গবেষণা ও ২০১৫ সালে হিউমান রাইট্স ওয়াচের করা একটি প্রতিবেদন বলছে, সময়মতো মজুরি না পাওয়া, কাজের সময়কাল ঠিক না থাকা, ছুটি জটিলতা, ক্ষতিপূরণ নিয়ে ঝামেলা, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব, শারীরিক ও মৌখিক দুর্ব্যবহার ও হুমকিসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন শ্রমিকরা।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক লাইলা জেসমিন বানু বলেন, ‘সবিতা রানীর মতো আহত শ্রমিকের দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আমরা চাই না কোনো শ্রমিক নির্মম দুর্ঘটনার শিকার হোক। তাই শ্রমিকদের নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারী যদি নিরাপত্তা না পায়, ভালো খাবার না পায়, ভালো পরিবেশ না পায়, তবে তার পরবর্তী প্রজš§ খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে। তাদের সন্তানরাও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে।’
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পরিচালক আসগর আলী সাবরী বলেন, ‘নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা গেলে পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এ কারণে নারী শ্রমিকদের সব রকম বৈষম্য থেকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণে সুনির্দিষ্ট ও রক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকা দরকার। যেখানে মালিক-শ্রমিকসহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ তাইয়েবুল ইসলাম বলেন, ‘একজন নারী শ্রমিক যদি মানসিক শান্তিতে কাজ করতে পারেন এবং তাকে যদি ভালো পরিবেশ দিতে পারি তবে আমাদের শিল্পের উন্নতি হবে। আসলে বিষয়টি অনেক কঠিন, কারণ এর সঙ্গে নানা সামাজিক বিষয় জড়িত। এগুলোর সমাধান একটু কঠিন। সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে শ্রমিকেদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে।’
আলোচকরা বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কনভেনশনের আলোকে নারী শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে যে আইনগুলো প্রণীত হয়েছে সেগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেইসঙ্গে বর্তমান সময়ের আলোকে নারী শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যুগোপযোগী ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করতে হবে।