নিজস্ব প্রতিবেদক: তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ২৮ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল তৈরি পোশাকশিল্পে ন্যূনতম মজুরি এবং জীবনযাত্রার অবস্থা নিয়ে সিপিডি আয়োজিত সংলাপে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানসহ বিভিন্ন পক্ষের শ্রমিক নেতা।
সংলাপে একটি জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে এ জরিপটি করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকার চেয়ে গাজীপুরে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক বেশি। তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের পরিবারপ্রতি ব্যয় গড়ে ২২ হাজার ৪০০ টাকা। একটি শ্রমিক পরিবার ঢাকায় প্রতি মাসে প্রায় ২৩ হাজার টাকা ব্যয় করে। গাজীপুরে পরিবারপ্রতি ব্যয় ২৪ হাজার ৮০০ টাকার বেশি। জরিপকালে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ শ্রমিক নিজেদের মধ্যে বাসা শেয়ার করে বসবাস করছেন। ৮৬ শতাংশ শ্রমিক টয়লেট শেয়ার করে ব্যবহার করেন। ৮৫ শতাংশ শ্রমিক রান্নার চুলা শেয়ার করেন। ১৭ শতাংশ শ্রমিক মেঝেতে ঘুমান এবং ১৬ শতাংশ শ্রমিকের ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা নেই।
সবকিছু বিশ্লেষণ করে সিপিডির পক্ষ থেকে তৈরি পোশাকশিল্পের মজুরি কাঠামোতে সপ্তম গ্রেড তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। সে সঙ্গে ষষ্ঠ গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ২৮ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করেন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি কাজী মো. রুহুল আমিন। সংলাপে তিনি বলেন, ঢাকা বা ঢাকার বাইরে কোথাও এখন একটি টিনশেড রুম পাঁচ-ছয় হাজারের নিচে পাওয়া যায় না। কোনোমতে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করা প্রয়োজন।
বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রমিকরা ১৬ হাজার টাকা দাবি করলেও এটি দুবছর আগের দাবি। প্রকৃত মজুরি এর চেয়েও বেশি হওয়া প্রয়োজন।
গার্মেন্ট ওয়ার্কার ফেডারেশন সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, আগের দুটি মজুরি বোর্ড সুপারিশ করলেও প্রধানমন্ত্রীকে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণায় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। এবারও তাই করতে হবে।
তৈরি পোশাকশিল্পে ‘জাস্টিস’ তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এ শিল্পের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, শুধু মজুরি দিয়ে নয়, তাদের এ বিষয়টি মানবিকভাবেও দেখতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে পণ্য পাঁচ ডলারে উৎপাদন করা হয়, সেটি ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠান ২০ ডলারে বিক্রি করছে। মাঝখানের ১৫ ডলার নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। আমরা যখন ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কথা বলব, তখন জাস্টিস বা ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলতে হবে। আমাদের সন্তানরা কিছুদিন যাবৎ রাস্তায় নেমে যে আন্দোলন করছে, সেটিও ‘জাস্টিস’-এর জন্য। এদেশের ৩০ লাখ মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তারাও ‘জাস্টিস’ চেয়েছিলেন। তৈরি পোশাকশিল্পে দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, বিশ্ববাজারে অ্যাপারেলের চাহিদা কমে যাচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোশাকের দামও কমে গেছে। আমরাও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি করতে চাই; কিন্তু এর পাশাপাশি মালিকপক্ষের সক্ষমতাও থাকতে হবে। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে মজুরি বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি সবাইকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সবাই তৈরি পোশাকশিল্প শ্রমিকদের নিয়ে কথা বললেও এ শিল্পের বাইরে যে বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের কথা বলেন না। তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেসব শ্রমিককে নিয়ে গবেষণার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ারদেরও মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলতে হবে। আলোচনায় শ্রমিকদের রেশন ব্যবস্থার দাবি জানানো হলে তিনি বলেন, সরকার যে চাল তাদের দেয়, সেটি গার্মেন্ট শ্রমিকরা গ্রহণ করেন না। গার্মেন্টশিল্প এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে শ্রমিক নেতাদের সরব হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা প্রস্তাব সিপিডির
