Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:36 pm

পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ ও ভারত

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: পোশাক শিল্প হল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানী খাত। বাংলাদেশের মোট রপ্তানীর ৮১.৮১ ভাগ আসে এই শিল্প খাত থেকে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে পোশাক রপ্তানীতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্ধিতীয় । প্রথম অবস্থানে ছিল চীন। ২০২১-২২ অর্থ বছরে শুধু মাত্র পোশাক শিল্প থেকে বিদেশী রেমিটেন্স এসেছে ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র এর ব্যবসায়ীরা চীন ও ভিযেতনাম থেকে এ বছর ৪০ শতাংশ তৈরী পোশাক আমদানী করেছে। আর বাংলাদেশ থেকে আমদানী করেছে ৯ শতাংশ। অপর দিকে ভারত থেকে আমদানী করেছে ৫ দশমিক ৬৯ ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানী বেড়েছে ভিযেতনামের কমেছে বাংলাদেশের।অন্য দিকে ভারতে সম্প্রসারিত হচ্ছে পোশাক শিল্প এর বাজার ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ কর্মাস এর আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্স) এর প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের সাত মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৩৬৩ কোটি ডলারের পোশাক আমদানী করেছে। যা গত বছরের এই সময়ের চাইতে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। তবে সবচেয়ে বেশী কমেছে বাংলাদেশের পোশাক । বাংলাদেশে বর্তমানে চার হাজারের অধিক পোশাক কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের প্রসার ঘটেছিল খুবই দ্রুত। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পোশাক কারখানা ছিল মাত্র ৪৭ টি, ১৯৮৫ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৫৮৭ টিতে, ১৯৯৯ সালে তার সংখ্য হয় ২৯০০ আর ২০০৯ সালে তার সংখ্যা দাড়ায় তিন হাজারের অধিক । যা বর্তমানে চার হাজারের বেশী। ১৯৯০ সাল থেকে এই শিল্পের বার্ষিক সম্প্রসারন হার প্রায় ২২ শতাংশ।

১৯৮৩-৮৪ অর্থ বছরে তৈরী পোশাক রপ্তানী বাংলাদেশ আয় করেছে ০.৯ বিলিয়ন ডলার। যা ছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ৩.৮৯ শতাংশ। ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে পোশাক খাত থেকে পাওয়া যায় ৫.৫১ বিলিয়ন ডলার যা মোট রপ্তানী আয়ের ৭৫.৬৭ শতাংশ। তবে ণীট বৈদেশিক আয় ছিল এই খাত থেকে ৩০ শতাংশ। কারণ বাদবাকী অংশ পোশাক শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ কিনতে আমদানী ব্যায় মিটাতে হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরেও লক্ষমাত্রা অর্জন করেছে এই শিল্প ৪৬৮০০.০০ মিলিয়ন ডলার। ৪ মার্চ ২০২৪ বিভিন্ন গনমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায় দেশের মোট রপ্তানী আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে।

পোশাক শিল্প কারখানার কর্ম পরিবেশ নিয়ে ছিল নানা ধরনের প্রশ্ন। আজ থেকে এক যুগ আগে পরিবেশ বান্ধব সবুজ পোশাক কারখানা ছিল মাত্র একটি। এখন সেই সংখ্যা বাড়িয়ে দাড়িয়েছে ২১৪ টিতে। বর্তমানে বিশ্বের ১০০ টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৫৬ টিই বাংলাদেশে। ২৮ মে ২০২৪ এসে বাংলাদেশের ২১৮ টি পোশাক কারখানা পরিবেশ বান্ধব সবুজ কারখানা হিসাবে স্বিকৃতি পায়। চলডিত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এসে এর সংখ্যা বেড়ে যায় তা বেড়ে দাড়ায় ২২৯ টিতে।

বর্তমানে প্রতি বছর শত শত নতুন কারখানা হচ্ছে অপরদিকে বন্ধও হচ্ছে শত শত কারখানা। এর কারণ বর্তমান আর্ন্তজাতিক বাজারে টিকে থাকাটাই বড় বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশসহ শীর্ষ পাচ রপ্তানীকারক দেশের পোশাক রপ্তানী কমেছে। ৫ আগষ্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর, পোশাক শিল্পে দেখা দিয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা। কারখানা গুলিতে সৃষ্টি হয়েছিল চরম বিশৃংখলা। যা এখনো অনেক জায়গায় চলছে। এই বিশৃংখলার মুল কারণ শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন না পাওয়া , বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট , এবং নতুন করে পে স্কেল ঘোষনা করা ইত্যাদি দাবীতে । গত মাসের ১৪ তারিখে ঢাকার উত্তরায় বিজিএমই ভবনে পোশাক শিল্পের সংকট নিয়ে এক মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই মতবিনিময় সভা পর পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি সাধন হয়নি। দিন দিন বাড়ছে কারখানা ভাঙচোরের মত ঘটনা । শ্রমিকদের পক্ষ বিপক্ষ আন্দোলন করে একে অন্যকে হেনস্থা করছে। রাজপথ অবরোধসহ গাড়ী ভাঙচোরের মত ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের বাংলাদেশের সিংহভাগ পোশাক কারখানা ঢাকার আশুলিয়া, সাভার , গাজীপুর , ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত। এই কারখানার অসন্তোষের কারনে এই এলাকা গুলোতে দেখা যাচ্ছে নানা রকমের বিশৃংখলা। এলাকার সামাজিক শান্তি নষ্ট হচ্ছে।

এই অবস্থার দ্রুত নিয়ন্ত্রনে আনা দরকার। পোশাক কারখানা দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে মারত্বক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই শিল্পে বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত আছেন প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমজীবি। কোন কারণে এই শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে সারা দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। সামাজিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। একটি গনমাধ্যমের সুত্র থেকে জানা যায় , গত ২ অক্টোবর ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার নবী নগর ুচন্দ্রা সড়কে ৫২ ঘন্টা অবরোধ ডাকে শ্রমিক সংগঠন গুলো। তারপর পুলিশের আশ্বাসে দুপুর একটার দিকে তা প্রত্যাহার করে শ্রমিকেরা। চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন করে বন্ধ হয়ে যায় ১০ টি কারখানা। চাকুরীচ্যুত শ্রমিকদের পুর্ণবহাল এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবীতে গাজীপুরের ভোগরা এলাকায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে। এই অবরোধের কারনে সাধারন মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। তখন মালিকরা ঐ এলাকার ১০ টি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন এলকায় দফায় দফায় বিক্ষোভের মুল কারণ হলো শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা। এই ধারায় বলা আছে , কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা বিভাগে বেআইনী ধর্মঘটের কারণে মালিকরা উক্ত শাখা আংশিক বা সম্পুর্ণ রুপে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে পারে ,এবং এ রুপ ধর্মঘটে বন্ধ হওয়ার কারণে ধমর্ঘটে অংশগ্রহনকারী শ্রমিকরা কোন মজুরী পাইবে না।

এই আইনের কারণে বন্ধ হওয়া অনেক গার্মেন্ট শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন পাচ্ছেন না। এই আইনের ফলে শ্রমিকরা পাচ্ছে না তাদের নায্যতা। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে নারী ও পুরুষ শ্রমিক দ্ধন্ধ। উক্ত আইনের কারণে মালিকরা শ্রমিক আন্দোলনকে নাশকতা বলে আখ্যা দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অস্থিরতার কারণে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের অর্ডার ফেরত নিচ্ছে। অপরদিকে সময়মত পণ্য বায়ারদের কাছে পণ্য পাঠাতে পারছে না পোশাক মালিকরা। এর ফলে আর্ন্তজাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে। অপর দিকে আর্ন্তজাতিক বাজারে ভারতের পোশাক শিল্পের কদর বাড়ছে।ভারতের ব্যবসায়ীরা শ্রমঘন শিল্পের চেয়ে পুজিঘন শিল্পের দিকে বেশী আগ্রহী , তাই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পোশাক শিল্পের দিকে আগ্রহ কম ছিল। বর্তমানে আর্ন্তজাতিক বাজারে নতুন ভাবে ভারতীয় তৈরী পোশাকের পোশাক রপ্তানী বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্রম বৃদ্ধিয়মান অস্থিরতার কারণে এই বাজারটা হয়ত ভারতের দখলে চলে যেতে পারে। অর্থ মুল্যের দিক থেকে ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কম পোশাক রপ্তানী করেছে । বাংলাদেশ যে পরিমানে পোশাক রপ্তানী করেছিল ভারত সেই তুলনায় করেছে তার মাত্র ২৫ শতাংশ।

সম্প্রতি ভারতের তামিল নাড়ু প্রদেশের ত্রিপুর শহরের পোশাক প্রস্তকারী প্রতিষ্ঠান গুলো ৫৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন পোশাক উৎপাদনের কার্যাদেশ পেয়েছে। এর কারণ হিসাবে তারা জানিয়েছে , বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতের অস্থিরতার জন্য তাদের কাছে এই কার্যাদেশ এসেছে। বিভিন্ন পোশাক উৎপাদন গোষ্ঠি বলছে আগষ্ট মাসে বৈশ্বিক ব্রা্ল জারার কাছ থেকে গত সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশী পোশাক রপ্তানীর কার্যাদেশ পেয়েছে ভারতীয় পোশাক প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান গুলো। বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্চ থাকা সত্বেও ভারতীয় তৈরী পোশাকের রপ্তানী বেড়েছে। গত বছরের আগষ্ট মাসের তুলনায় এ বছরের আগষ্ট মাসে ভারতের পোশাক রপ্তানী বেড়েছে ১২ শতাংশ। শুধু মাত্র আগষ্ট এক মাসে ভারতের পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে ১২৬ কোটি ডলার। এ বছরের এপ্রিল থেকে আগষ্ট পর্যন্ত পোশাক খাত থেকে ভারতের আয় ৬৩৯ কোটি ডলার।

এই ধারাবাহিকতায় দেখা যায় ভারতের পোশাক খাত একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে এগুচ্ছে। ভারত এখন তৈরী পোশাক খাতে উচ্চ সম্ভাবনাময় প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে পা বাড়াচ্ছে। পরিবেশ ও সমাজের খেয়াল রাখার পাশাপাশি পণ্যের মান বাড়িয়ে বিশ্বের তৈরী পোশাক সেক্টরে বড় অংশ দখল করতে যাচ্ছে ভারত। ভারতের এইপিসির সেক্রেটারী জেনারেল মিথিলেশ ঠাকুর বলেছেন , সম্প্রতি মাস গুলোতে ভারতের পোশাক শিল্প খাত উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখছে। বিদেশী ব্রা্ল গুলো যে ভারতের উপর আস্থা বাড়াচ্ছে তা ষ্পষ্ট ।
বাংলাদেশের পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা যদি এই শিল্পটির অস্থিরতা কমাতে না পারেন অদুর ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পটি ভারতের হাতে চলে যাবে। যেমন করে পাট শিল্প ভারত দখল করে নিয়েছে।
উন্নয়ন কর্মী, মুক্ত লেখক