রোহান রাজিব: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রার অদল-বদলের আওতায় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭৫ কোটি (১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) ডলার রেখে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি তারল্য সহায়তা নিয়েছে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক। জমা রাখা ডলার বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভে যোগ হচ্ছে। এর মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়াতে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আকুসহ অন্যান্য আমদানি বিল পরিশোধের চাপে রিজার্ভ আগের তুলনায় কমেছে।
তথ্য মতে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতি চালু হয়। এর আগের দিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ‘বিপিএম৬’ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর কারেন্সি সোয়াপের আওতায় ব্যাংকগুলো ডলার জমা দেয়া শুরুর পর তা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারি বেড়ে হয় ২০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০ বিলিয়ন ৫৭ বিলিয়ন এবং ৬ মার্চ ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার হয়।
তবে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার আকু বিল পরিশোধের পর বাড়তে থাকা রিজার্ভ কমে যায়। ১৩ মার্চ রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন, ২১ মার্চ ১৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন এবং সবশেষ গত ২৪ মার্চ তা আরও কমে ১৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসেবে রিজার্ভের স্থিতি ছিল ২৫ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার।
অনেক আগে থেকে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ করতে পারে। তবে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও সোয়াপ চালু হয়। এ উপায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা বা ডলার রেখে ৭ থেকে ৯০ দিনের জন্য বিপরীত মুদ্রা নিতে পারে ব্যাংক। যে মুদ্রা নেয়া হয়, নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদসহ সে মুদ্রা ফেরত দিতে হয়। সোয়াপের ক্ষেত্রে সুদহারের হিসাব হয়Ñরেপো এবং ডলারের তিন মাস মেয়াদি বেঞ্চমার্ক রেট এসওএফআরের মধ্যকার পার্থক্যের ভিত্তিতে। বর্তমানে রেপোর সুদহার ৮ শতাংশ এবং এসওএফআর ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ফলে ব্যাংকগুলো এখন ডলার রেখে ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ সুদ পাবে।
জানা গেছে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংক সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রায় ১৭৫ কোটি বা ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার রেখেছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ঠিক করা ১১০ টাকা দরে এর বিপরীতে এসব ব্যাংক নিয়েছে ১৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে এসব ব্যাংক টাকা দিয়ে আবার ডলার ফেরত নেবে।
এদিকে ডলার সংকট কাটাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে তার সুফল কিছুটা দেখা যাচ্ছে। এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে স্থানান্তরভিত্তিক ডলার সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি নগদ বা ক্যাশ ডলারের সরবরাহও বেড়েছে। এতে ডলারের দর কিছুটা কমেছে।
জানা যায়, এখন খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়, যা দু-এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১২০ থেকে ১২২ টাকা। এর আগে তীব্র ডলার সংকটের কারণে এ দর সর্বোচ্চ ১২৬ থেকে ১২৭ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। মূলত ব্যাংকিং চ্যানেলে স্থানান্তরভিত্তিক ডলারের পাশাপাশি নগদ ডলারের সরবরাহ বাড়ার কারণে কমছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত নগদ ডলারের স্থিতি ছিল ৩ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। ২০ মার্চ ছিল ৩ কোটি ৯৩ লাখ, ১৩ মার্চ ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ডলার সংকটের সময় নগদ ডলারের স্থিতি ৯০ লাখে নেমেছিল।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমদানি ব্যয় হ্রাস, প্রবাসী আয়ে গতি এবং রপ্তানি আয় বাড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। আবার আরএফসিডি হিসাবে জমা ডলারে সুদহার বাড়ানো এবং প্রবাসীদের সুবিধাভোগীর নামে বৈদেশিক মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুলে জমার ওপর বাড়তি সুদ দেয়া হচ্ছে। ফলে মানুষের ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে ফেরত আসছে। এতে ব্যাংকিং খাতে নগদ ডলারের সরবরাহ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা ধারণের সীমা নেট ওপেন পজিশন লিমিট (এনওপি) গত ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল ৩১২ মিলিয়ন ডলার, যা গত ১৪ মার্চে বেড়ে ৭০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
এছাড়া ফেব্রুয়ারি শেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫৩ কোটি (৫ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। ডলার সরবরাহে কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এলসি খোলা বেড়েছে।
জানা যায়, সব পর্যায়ে ডলার সরবারহ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দামও আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এখন আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম নেয়া হচ্ছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১২২ থেকে ১২৪ টাকা। তবে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম এর থেকেও ১০-১২ টাকা কম নির্ধারণ করা আছে। সর্বশেষ বাফেদা ও এবিবি মিলে আমদানিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করে ১১০ টাকা। যদিও এ দামে কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ফলে ডলারের সরবরাহ অনেক বেড়েছে। আবার আরএফসিডি হিসাবে জমা ডলারে সুদহার বাড়ানো এবং প্রবাসীর সুবিধাভোগীর নামে বৈদেশিক মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুলে জমার ওপর বাড়তি সুদ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মানি চেঞ্জারগুলোও ডলারের দর কমিয়েছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে বলে আশা করা যায়।