নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে ‘প্রকট’ রাজনৈতিক বৈরিতা বিরাজমান বলে মন্তব্য করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, এ বৈরিতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া কমিশনের জন্য ‘কঠিন হয়ে দাঁড়াবে’।
সব ধরনের তিক্ততা পরিহার করে রাজনৈতিক দলেগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসতে ফের তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক এই সংস্থার প্রধান।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও কোনো আলাপ-আলোচনা আমি দেখছি না। তাদের মধ্যে বৈরিরা অত্যন্ত প্রকট।’
এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন সিইসি।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গতকাল রোববার দুপুরে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিইসি। এর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে।
নির্বাচনী হলফনামার তথ্য প্রকাশ, হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ইসির সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিনিধিদল।
বৈঠকের বিষয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও তার কয়েকজন সহকর্মী এসেছিলেন। আমরা পুরো কমিশন তাদের সঙ্গে বসেছিলাম। আমরাই মূলত তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তার কারণটা হলো প্রায়ই আমাদের যোগাযোগ হচ্ছিল। তাই আমরা নির্বাচনের পরে আরও বড় পরিসরে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম।
সিইসি বলেন, হলফনামায় কে কী সম্পত্তির বিবরণ দিল, সেটা আমাদের কাছে থাকবে, বা আপলোড করে দিচ্ছি। যে কেউ তথ্য নিতে পারেন, দুদক নিতে পারে, আমরা সহযোগিতা করব। তবে আমাদের বলা হয়নি, তাদের স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে, কোনো কর্তৃত্ব বা দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি।”
হাবিবুল আউয়াল কমিশনের অধীনে ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ২৮টি দল শেষ পর্যন্ত ভোটে অংশ নেয়। ভোট বর্জন করে বিএনপিসহ সমমনা ১৬টি দল। ভোটের আগে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার তাগিদ এলেও শেষ পযন্ত তা হয়নি।
সিইসি বলেন, ‘ইসির অনন্ত সক্ষমতা রয়েছে এমন নয়। ইসি একা কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা দরকার।’
টিআইবির সঙ্গে ‘টোটাল’ নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানিয়ে সিইসি বলেন, তারা বলেছে, নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তবে ফেয়ার হয়েছে। একটা দক্ষতার অভাব রয়েছে। সেটা তারা জোর দিয়ে বলেছেন। আমরা বলেছি, আমাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করা। আমরা বলেছি, সমস্যা অনেকটাই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সমস্যা নিরসন না হলে নির্বাচন ব্যবস্থাটা আরও স্টেবল হবে না। পলিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা হয়ে গেলে নির্বাচনটা আরও সুন্দর হতে পারে।”
সিইসির ভাষ্য, ‘প্রপোরশনাল বলে একটা সিস্টেম আছে, আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা, যেটা আমাদের সংসদে নারী আসনের ক্ষেত্রে আছে, সেই সিস্টেমের কথা আমরাও বলেছি, তারাও বলেছেন।
আমরা বলেছি, এগুলো নিয়ে আপানারা গবেষণা করতে পারেন। আর আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনটা যদি স্ট্যাগারিং করা যায়, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ হয়ে যাবে। ভোটকেন্দ্রে অধিক সংখ্যক ফোর্স মোতায়েন সহজ হবে। মনিটরিংটা সহজ হবে।
আরেকটা জিনিস বলেছি, আমাদের যে প্রযুক্তি ইভিএম। সেটা নিয়ে অনাস্থা ছিল, এখনও আছে। আমারা এখনও বলেছি, ইভিএমে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে এখানকার ভোট ওখানে চলে গেছে। আমরা এখন অনেক স্পষ্ট, এই মেশিনে সেটা একেবারেই অসম্ভব। তবে ইভিএমটাকে আরও সহজ করা যেতে পারে।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, জবাবদিহিমূলক সুশাসনকে প্রাধান্য দিয়ে কয়েকটি নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। সংসদের পুরো মেয়াদের একটি বিশ্লেষণ আমরা সম্প্রতি প্রকাশ করেছি।”
কোনো কোনো ক্ষেত্রে হলফনামার তথ্য এবং আয়করের তথ্য বিশ্লেষণের সুযোগ হয়েছিল, সে কথা তুলে ধরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট নজরদারি সংস্থাগুলোর জন্য জবাবদিহি নিশ্চিতের সুবিধা করে দেয়া হয়েছে।’
ইসি এবং টিআইবি ‘একে অপরের সহযোগী’ হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ নির্বাচন চায়, এটা আমরাও চাই। আমাদের কাজের পদ্ধতি এবং ক্ষমতার পার্থক্য থাকলেও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই।’
নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করার কথা জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিশেষত সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রণয়নের। ইসিও আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, এটির আরও চাহিদা সৃষ্টি করা দরকার।”
তিনি বলেন, ‘গত সংসদ নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে, তবে তা ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। এ বিষয়ে ইসিও ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা জানিয়েছে, যতটুকু সক্ষমতা ছিল সে অনুযায়ী কাজ করেছে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচন দফায় দফায় করার সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটি উল্লেখ করেছেন, দফায় দফায় নির্বাচন আয়োজন করে সুবিধা হতো। একটি প্রস্তাব তিনি করেছেন, এক দিনে যে নির্বাচন হয়, সেটা পর্যায়ক্রমে করা যায় কি না। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাঁচ দফায় নির্বাচন করা যায় কি না, সে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন।”