ইসমাইল আলী: জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ১৬৩ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এটিকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার প্রকল্প নিতে যাচ্ছে রেলওয়ে। চীনের অর্থায়নে জিটুজি ভিত্তিতে রেলপথটি নির্মাণে আগ্রহী চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। দরপত্র ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যেই রেলপথ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
তথ্যমতে, ২০১৬ সালে প্রকল্পটির প্রাথমিক ডিপিপি বা পিডিপিপি অনুমোদন করা হয়। সে সময় জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল সাত হাজার ২৯৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। এরপর প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এতে ব্যয় কিছু বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ২৩৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত বছর এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে এরপর অর্থায়নের উৎস খোঁজা শুরু করে রেলওয়ে। এতে আগ্রহ দেখায় চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। রেলপথটি নির্মাণে জিটুজি ভিত্তিতে চীনের ঋণ সরবরাহের আশ্বাসও দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে দর-কষাকষির ভিত্তিতে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করে রেলওয়ে। এতে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। পরে তা আরও কিছুটা বেড়ে হয় ১৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
সম্প্রতি প্রকল্পটি চূড়ান্তে বৈঠক আহ্বান করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ অনুমোদনের আগেই দুই বছরের মধ্যে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে ছয় হাজার ৯৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা, যা পিডিপিডির তুলনায় ৯৫ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। এছাড়া প্রকল্পটির কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ও চলমান ও প্রস্তাবিত অন্যান্য ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চলতি বছর অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর।
সূত্রমতে, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথ ডাবল লাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আট হাজার ৭৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দেবে চীন। আর পাঁচ হাজার ৫২৩ কোটি ৬২ লাখ সরকারি তহবিল থেকে সরবররাহ করা হবে। প্রকল্পটির আওতায় ১৬২ কিলোমিটার মূল রেলপথ ছাড়াও ১২ কিলোমিটার লুপ লাইন করা হবে। অর্থাৎ ১৭৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল রেলপথ নির্মাণ ব্যয় হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫৭ কোটি টাকার বেশি।
যদিও ভারতের ঋণে কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। এজন্য ব্যয় হবে ৫৪৪ কোটি ৮৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৪০ টাকা। গত বছর ১৫ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত চুক্তি সই করা হয়। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
এদিকে পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত ৬৬ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ১২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ফলে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আবার আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত বিদ্যমান ৯২ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন আরও ৯২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ কাজের চুক্তি মূল্য তিন হাজার ৪৯৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এতে নতুন রেলপথ নির্মাণসহ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৯ কোটি টাকা।
অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথ ডাবল লাইন নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি এখনও চূড়ান্তই হয়নি। এছাড়া ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য বিদ্যমান রেলপথটির কিছু অংশ পুনর্নির্মাণ করতে হবে। আবার প্রকল্পটিতে সেতুর সংখ্যা অনেক বেশি। ২০৪টি ছোট-বড় নির্মাণ ছাড়াও সাতটি স্টেশন পুনর্নির্মাণ, ১৪টি সংস্কার ও একটি স্টেশন নতুন নির্মাণ করতে হবে। ১৫টি স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে হবে। এসব কারণে ব্যয় কিছুটা বেশি হচ্ছে।
যদিও রেলওয়ের মহাপরিচালকের এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রকল্পটির আওতায় মাত্র ১০৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ফলে এ প্রকল্পের ব্যয় কোনোভাবেই নতুন রেলপথ নির্মাণের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। এছাড়া দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনধুম রেলপথ পুরোটা পাহাড়ি এলাকায় নির্মাণ করতে হবে। ওই প্রকল্পের পুরো এলাকাটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তবে উš§ুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করায় ওই প্রকল্পে ব্যয় অনেক কম হচ্ছে। তাই বিনা দরপত্রে দরকষাকষির মাধ্যমে চীনের ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
উল্লেখ্য, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনধুম রেলপথ প্রকল্পের আওতায় ১৪০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৪৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ ব্যয় জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের চেয়ে কিছুটা কম।