Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 4:41 pm

প্রকল্প বাস্তবায়নের জায়গা নির্দিষ্ট না হলেও বেড়েছে সময় ও ব্যয়

এনামুল হক নাবিদ, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম): বৈদেশিক ঋণ সহায়তায় সম্পন্ন হচ্ছে ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ছিল। তিন বছরের ওই প্রকল্প গড়াচ্ছে ছয় বছরে। এখনও কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ এ প্রকল্প। এমনকি প্রকল্পটির জায়গা পর্যন্ত এখনও চিহ্নিত হয়নি। অথচ এ সময়ে কাজের ভৌত অগ্রগতি ১৮ দশমিক ২২ শতাংশ বলে দাবি করছি পিজিসিবি। এর মাঝে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরও তিন বছর। তিন বছর পরে আনা হয়েছে সংশোধনী। এতে ব্যয় বেড়েছে ৫০২ কোটি ৪০ লাখ ৯১ হাজার টাকা। খরচ বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ। ঋণের বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে সুদ। ঋণের সঙ্গে সরকারকে টানতে হবে বাড়তি সুদের বোঝাও।

পিজিসিবি বলছে, দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে সঞ্চালন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। এই উন্নয়ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় স্থাপিত নতুন পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার অধিকতর উন্নয়নের জন্য মূল প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত ৮৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন হবে। চট্টগ্রাম শহর এবং এ অঞ্চলের নির্ভরযোগ্য ও ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার অবকাঠামোর উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

২০১৯ সালের ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদন পায় এ প্রকল্প। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৩৫৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যার মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৯২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং সরকারি তহবিল থেকে ছিল ৩৫৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। পরে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে এক হাজার ৯০৪ কোটি ১৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি প্রস্তাবিত সংশোধিত প্রকল্পটির সুপারিশ অনুযায়ী, মোট এক হাজার ৮৬১ কোটি ২৮ লাখ ৯১ হাজার প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এখন মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ৮৬১ কোটি ২৮ লাখ ৯১ হাজার টাকা। মেয়াদ বেড়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।

এ প্রকল্পে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ৯২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে এখন বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩০৯ কোটি ৩৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বেড়েছে। ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এতে ঋণের সঙ্গে বাড়ছে সুদ।

প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মূল প্রকল্পের আওতাভুক্ত একটি কাজ হচ্ছে হাটহাজারী-রামপুর ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট আন্ডারগ্রাউন্ড কেব্ল লাইন থেকে ২ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার লাইন-ইন লাইন-আউট নির্মাণ। উল্লিখিত এলআইএলও লাইন নির্মাণ কাজটি হাটহাজারী-রামপুর ২৩০ কেভি লাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা পিজিসিবির ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এনপিটিএনডিপি) শিরোনামে আরেকটি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রকল্পটির আওতায় হাটহাজারী-রামপুর ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনটি বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভাটিয়ারীর আপত্তির কারণে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই এটি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে এনপিটিএনডি প্রকল্পের আওতায় নির্মিত রামপুর উপকেন্দ্র এবং ওই প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য আনন্দবাজার উপকেন্দ্রের সোর্স নিশ্চিত করার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে খুলশী থেকে আনন্দবাজার ২৩০ কেভি ৬ দশমিক ১০ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড এবং আনন্দবাজার থেকে রামপুর পর্যন্ত ২৩০ কেভি ৩ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড সঞ্চালন লাইন নির্মাণে প্রয়োজনীয় কাজ হয়।

দ্বিতীয় পিএসসি সভার সিদ্ধান্তে নতুন ৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার ২৩০ কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড সঞ্চালন লাইনটি এই সংশোধিত প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং বিদ্যমান ২ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার লাইনটি প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

এসব প্রকল্পের সঙ্গে নাগরিক পরিবীক্ষণ নেই বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী এবিষয়ে মন্তব্য করে বলেন, একনেকে যে প্রকল্পগুলো অনুমোদন হয় তা জায়গা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সব কিছু নির্ধারণ করে তা অনুমোদন দেয়া হয়। অথচ দেখা যাচ্ছে, এই প্রকল্পের স্থানও এখনও পর্যন্ত নির্ধারিত হয়নি। তা সত্ত্বেও প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় দ্বিতীয়বারের মতো বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে জনগণের করের টাকা অপচয় হচ্ছে। এসব প্রকল্পে সঠিক পরিমাপ ও জরিপ হয় না। এর ফলে কিছুদিন পরে সংশোধনী আনা হয়। এতে বাড়ানো হয় সময় ও ব্যয়। তিনি বলেন, ‘শুধু এ প্রকল্পে নয়, অধিকাংশ প্রকল্পে দেখা যায়, তারা দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করে, পরে সংশোধনী এনে মেয়াদ ও বাজেট বাড়ায়। এই দেশে কোনো কিছুর জবাবদিহি নেই বললে চলে, যার ফলে মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে বলে আমি মনে করি।’

প্রকল্পটির বিষয়ে বারশত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম শাহ বলেন, এক হাজার ২০০ ইউনিয়নের দুধকুমড়া মৌজার প্রায় ৪০ একর তিন ফসলি জমি রয়েছে একটি মাঠে। মাঠের আশপাশে কৃষকের বাড়িঘর। কৃষিনির্ভর এই এলাকার মানুষ সারাবছর এই জমিতে উৎপাদিত ফসল খেয়ে বাঁচে। নিজের খেতে চাষ করা ফসলে সারাবছর তাদের সংসারের চাহিদা পূরণ করেন। সেই ৪০ একরের মধ্যে ৩৩ একর জমি উপজেলা প্রশাসন পিজিসিবি নামে অধিগ্রহণের জন্য চিঠি ইস্যু করে। তারা বলছে, প্ল্যান্ট বসানোর জায়গার মূল্য দেবে, কিন্তু যেদিক দিয়ে লাইন যাবে, তার কোনো মূল্য দেবে না। তাহলে লাইন যাওয়ার মাধ্যমে যে এতগুলো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মূল্য কে দেবে? আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার তাদের বৈঠক হয়েছে। আমরা তাদের সাগরের তলদেশ দিয়ে লাইন নেয়ার পরামর্শ দিয়েছি।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) প্রকৌশলী প্রকল্প পরিচালক মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের কাছে প্রকল্পের বিষয়ে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি।