সুমাইয়া আক্তার: সময়ের ক্রমধারায় আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে। প্রকৃতির মধ্যে কাটানো রঙিন জীবন এখন প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি তথাকথিত আধুনিক জীবনধারায়। প্রযুক্তির আশীর্বাদে অনেক কঠিন কাজকে যেমন দ্রুত ও সহজে করা সম্ভবপর হয়েছে, ঠিক তেমনি এই প্রযুক্তির প্রভাবে আমাদের চালচলন, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে ও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
একসময় সকালবেলা আমাদের ঘুম ভাঙতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর মোরগের ডাকে। আর এখন ঘুম ভাঙে ডিজিটাল অ্যালার্মের শব্দে। ছোটবেলায় আমরা বাবা মায়ের কাছে যে আবদারগুলো করতাম তা ছিল গ্যাস বেলুন, পুতুল, খেলনা গাড়ি, খেলনা হাড়ি পাতিল ইত্যাদি। আর এখনকার শিশুরা বায়না করে রিমোট কন্ট্রোলের গাড়ি, হেলিকপ্টার, প্লে স্টেশন, আইপ্যাডে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে।
১৫ বছর আগের কথা যখন আমরা জানতামই না ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার মানে কী। আমাদের ছোটবেলায় স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, কম্পিউটার কিছুই ছিল না। তখন স্কুলে যাওয়া ও একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে যে সময়টা পেতাম সেটা কাটাতাম বিভিন্ন ধরনের মজার খেলা খেলে। আমরা ছোটবেলা যে খেলাগুলো খেলতাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলÑবউচি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, সাত চাঁড়া, বরফ পানি, কানামাছি, জুতা চুরি, কলমকাটি ইত্যাদি। এখনকার যুগের শিশুরা এসব খেলা তো দূরের কথা, বেশিরভাগই হয়তো এ খেলার নামগুলোর সঙ্গেই পরিচিত না। আমাদের সময় টিভিতে এত চ্যানেলও ছিল না। আমাদের ছোটবেলায় শুধু একটা চ্যানেলই ছিল বিটিভি আর টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বলতে সিসিমপুর, আলিফ লায়লা আর হানিফ সংকেত পরিচালিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। এখন তো শত শত চ্যানেল, শত শত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান এবং অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। কখনও কখনও আমরা লুডু, ক্যারম, দাবাও খেলতাম। মাটিতে বসে প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মোবাইল, কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইসেও এসব খেলা যায়। তবে সত্যি বলতে বাস্তবে খেলার মতো আমেজটা আর কৃত্রিম ডিভাইসে খেলার মাঝে অনুভব করা যায় না।
ছোটবেলায় বৃষ্টি হলে আমরা মায়ের চোখ আড়াল হলেই বাইরে গিয়ে ভিজতাম, গড়াগড়ি খেতাম কাদা মাটিতে। বর্ষার পানিতে যখন চারদিক টইটম্বুর করত, তখন পুকুরে গোসল করতাম আর এখনকার শিশুদের তো পড়াশোনার জন্য স্কুলে যাওয়া ব্যতীত ঘর থেকেই বের হতে দেয় না মা-বাবা অসুখ-বিসুখের ভয়ে।
আমরা ছোটবেলায় স্কুলের একাডেমিক পড়ার জন্য এত বেশি প্রাইভেট, কোচিং করতাম না; বর্তমান যুগের মতো প্রতিযোগিতা এত তীব্র ছিল না; তাই বলে যে আমরা পড়াশোনা করতাম না বা ক্লাসে ফার্স্ট হতাম না ব্যাপারটা তেমন না। পড়াশোনা যেমন করতাম তেমন খেলাধুলা ও করতাম প্রচুর। এখনকার শিশুদের স্কুলে ক্লাসের পর ও একটার পর একটা প্রাইভেট কোচিংয়ে দেয়া হয়। শিশুদের প্রতিযোগিতাটা যেন মা-বাবাদের হয়ে গেছে, কার ছেলে, কার মেয়ে পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে, কার সন্তান বেশি নম্বর পাবে। আমাদের ছেলেবেলায় মোবাইল, ইন্টারনেট ছিল না। বর্তমানের মতো এত অশ্লীলতার ছড়াছড়ি ছিল না। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে দেখা যায় ছেলে-মেয়েদের হাতে হাতে ফোন। বাইরে খেলাধুলার পরিবর্তে মোবাইল, কম্পিউটারে অনলাইন গেমসকে তারা বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছে। টিভির সামনে তারা ভিনদেশি অশ্লীল সংস্কৃতি নিয়ে পড়ে আছে। ফেসবুক নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় সারা দিনরাত অ্যাকটিভ তারা। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েই সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ফেসবুকের অকল্যাণকর ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে মোবাইল প্রেম, অনলাইনে অবাধ ভার্চুয়াল যোগাযোগ, অবশেষে প্রেম, ব্যভিচার ও নষ্টামি।
সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে আমরা যে রঙিন শৈশবের সোনালি দিনগুলো কাটিয়েছি, তা এখনকার যুগের শিশুরা উপভোগ করতে পারে না। কারণ তাদের শৈশব এখন প্রযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। প্রযুক্তি যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যাবলিগুলোকে সহজ করে তুলেছে ঠিক, তেমনি তার একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে আর তা হলো প্রযুক্তি আমাদের দিন দিন প্রকৃতি থেকে সরিয়ে ফেলছে; যার প্রভাবে ঘটছে নৈতিকতার অবক্ষয়?। অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা কখনোই আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। প্রকৃতির মধ্যে আমরা যে আনন্দ পাই, তা কখনও প্রযুক্তির দ্বারা পূরণ করা যাবে না। কারণ প্রকৃতি মানেই প্রকৃত, যা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এবং অতুলনীয় আর সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সবসময় নির্ভুল ও নিখুঁতই হয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রযুক্তি মানেই কৃত্রিম সৃষ্টি বা মানুষের সৃষ্টি; যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে।
তাই আসুন সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাই। শিশুদের প্রযুক্তির অপরিণামদর্শীতায় ফেলে না দিয়ে তাদের প্রকৃতির মাঝে নিয়ে আসি। আমাদের মতো তাদের শৈশবটাও সোনালি, রঙিন ও স্মরণীয় করতে তাদের প্রযুক্তি নির্ভরতা কমিয়ে বাস্তবমুখী করে তুলি। বিনোদনের জন্য হাতে হাতে ফোন না দিয়ে খেলার মাঠে নিয়ে আসি। প্রযুক্তির অপব্যবহার না করে যদি তারা প্রকৃতির মধ্যে বেশি সময় কাটায়, তাহলেই আজকের দিনের শিশুরা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে এবং অপকর্ম, অশ্লীলতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় হতে রক্ষা পাবে এবং জীবন হবে সুন্দর ও রঙিন।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়