কামরুন নাহার মুকুল: আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে কিশোরীটি কাঁদছিল। কারণ জানতে চাইলে সে বলল, ‘আমি তো গার্মেন্টসে কাজ করতাম। আমার রোজগারে সংসার চলতÑকেন আমারে কম বয়সে বিয়া দিল পেটে বাচ্চা আসলো! ডাক্তার বললেন, বাচ্চাটা নাকি রক্তের সঙ্গে পইড়া গেছে’বলতে বলতে নেতিয়ে পড়ে সে পাশে বসা বয়সী আরেক নারীর ওপর।
সৃষ্টিজগতের সব সৃষ্টির এক রহস্যময় সৃষ্টির নাম নারী। নারী একটু বেশিই রহস্যময়ী। তাই নারীর স্বাস্থ্যরক্ষাও যেন পুরুষের চেয়ে ভিন্ন। একজন নারী জন্মের পরই নারী হয়ে ওঠে না। ধাপে ধাপে পথ পাড়ি দিয়ে এগোতে হয় তাকে; মিষ্টি-মধুর শৈশবকে পার করে কৈশোরে পা রাখে যখন, নারী হয়ে ওঠার পথ যেন শুরু হয় তার। কৈশোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নারী-পুরুষ সবার জন্য, বিশেষ করে নারীদের জন্য। এ সময়টাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। এ সময়ে ছেলে ও মেয়ে, উভয়ের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। তবে চিকিৎসকদের মতে, এ সময়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে বেশি মানসিক চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এছাড়া মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে কিছুটা আগেও শুরু হয়।
একটি মেয়ে পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠে তার মাসিকের মাধ্যমে। আমাদের সমাজে মাসিক বা পিরিয়ড শব্দটিকে লজ্জা, সংকোচ ও বিব্রতকর হিসেবে দেখা হয়। বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর যে, মেয়েটি তার জীবনের আকস্মিক পরিবর্তনের কথা কারও সঙ্গেই মন খুলে বলতে পারে না। ভয়, লজ্জা ও সংশয় মানসিকভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়; যা তার ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলে। এমনকি তার মধ্যে প্রজননস্বাস্থ্য নিয়েও অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। এ সময়ে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতা পেলে ভয়, সংকোচ, নেতিবাচক ভাবনা ও মানসিক অস্বস্তি কমে যায় তার। নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার সঙ্গে মানসিক অবস্থা খুব শক্ত ও মৌলিকভাবে জড়িত।
প্রজননস্বাস্থ্য বলতে সাধারণত প্রজননের সঙ্গে অঙ্গগুলোর স্বাস্থ্যকেই আমরা বুঝে থাকি, কিন্তু আসলে বিষয়টা তা নয়। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা, বয়ঃসন্ধিকালের যত্ন, সন্তান জন্মদানের জন্য গর্ভধারণ, পরিবার-পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নির্বাচন, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কসহ এ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ই মূলত প্রজননস্বাস্থ্য এ তথ্যটি অনেকেই বুঝতে ভুল করেন। প্রজনন বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করাকেও লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয় আমাদের সমাজে। তাই এ বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকায় সমাজে রয়ে গেছে অজ্ঞতা। অথচ এই প্রজননস্বাস্থ্য সামগ্রিক সুস্থতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রজননস্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সার্বিকভাবে সুস্থ থাকা যায় না। প্রজননস্বাস্থ্য সবার জন্য তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে নারীর সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। মাসিকের সময়ে সতর্কভাবে তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা আবশ্যক। নিরাপদভাবে এ সময় না থাকলে নানা রোগে তাকে ভুগতে হয়। পরবর্তী সময়ে এর ফলে নারীকে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার তীব্র আশঙ্কাও রয়ে যায়। সুতরাং এ সময়ে নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা শতভাগ জরুরি। সুস্থ থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অপুষ্টির শিকারে ভোগে নারীরা বেশি। তাই এ সময়ে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সুষমখাদ্য, প্রচুর পুষ্টিকর খাবার এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। পানি শরীরের ত্বককে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করার অভ্যাসও রাখতে হবে। পাশাপাশি, সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমেরও প্রয়োজন, কারণ ঘুম মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধের চাপ কমায়; উপরন্তু শরীরের কোষগুলোকেও আরাম দেয়।
শৈশব থেকেই তাই প্রজনন স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হয়, যা তাকে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দিতে হয় পরিবার থেকে। কারণ একটি শিশু ঠিকভাবে পুষ্টি না পেলে তার প্রজনন অঙ্গগুলো ঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেছেন, নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেসিসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।
নারীর সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রজননস্বাস্থ্যকে অস্বীকার করার যেমন কোনো উপায় নেই; তেমনি অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাকেও গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান করারও কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে রয়েছে বড় এক প্রজননক্ষম জনগোষ্ঠী, ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগেরও বেশি। তবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও সচেতনতার অভাবে তাদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ নারীরই ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এদের অধিকাংশের মধ্যেই যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি না থাকায় কিশোরী মাতৃত্বহার বাড়ছে। তাই যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে আর লজ্জা নয়, বরং সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। বহু উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। কিন্তু প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ের অগ্রগতি সে অর্থে হয়নি। একটা বাল্যবিয়ের অর্থ একটা সম্ভাবনার মৃত্যু। এই বাল্যবিয়ের সঙ্গে কিশোরীর প্রজননস্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শুধু বাল্যবিয়েই নয়, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী সবার জন্য প্রজননস্বাস্থ্যের যতœ বিষয়ে সচেতনতা আবশ্যক। বাংলাদেশের মাত্র ১৩ শতাংশ নারী প্রসবকালে দক্ষ ধাত্রীর সেবা পান এবং সন্তান জন্ম দানের সময় প্রতি বছর প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার প্রসূতি নারীর মৃত্যু হয়। প্রসবকালীন জটিলতার কারণে প্রতি ৪৫ মিনিটে একজন মায়ের মৃত্যু হয়। প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী অনেকাংশে।
কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মানুষের জড়তা ও সামাজিক কুসংস্কার দূর করে সুশিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষক এবং গণমাধ্যমও এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন প্রজš§কে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। কৈশোরকালেই সন্তানদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক তথ্য জানানো নিশ্চিত করতে হবে। জ্বর, সর্দি ও কাশির মতো নারীর মাসিককেও স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখতে হবে। সমাজের সে দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনতে আমাদের কাজ করতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সসীমাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। এই বয়সসীমার জনগোষ্ঠী কিশোর-কিশোরী আর প্রজননস্বাস্থ্য শুধু প্রজননতন্ত্রের কার্য ও প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ বা অসুস্থতার অনুপস্থিতিকেই বোঝায় না, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণকর এক পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পাদনের অবস্থাকেই বোঝায়। তাই পাঠ্যপুস্তকের বয়ঃসন্ধিকাল প্রজননস্বাস্থ্যবিষয়ক অধ্যায়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষকদের এড়িয়ে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সে বিষয়ে তাদের সঠিক তথ্য দেয়া প্রয়োজন। যাওয়ার জন্যও নির্দেশনা প্রদান জরুরি। প্রয়োজনে সচেতনতার জন্য অভিভাবকদের নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষকদের সভা করাও প্রয়োজন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চোধুরী বলেন, নারীর প্রজননস্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক বিষয়। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য টয়লেট স্থাপনসহ যুগোপযোগী আরও যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেনÑতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এসব উদ্যোগের কারণে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর সুস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সুস্থ জাতি গঠনে নারীর সুস্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর সুস্বাস্থ্যের জন্য নারীসহ সবার, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
পিআইডি নিবন্ধন