প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ ও বাল্যবিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত

মো. হাবিবুর রহমান: গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদীর মধ্যে জেগে উঠেছে তানাঘাট চর। মাত্র ১০৭টি পরিবারের সদস্য বাস করে এই চরে। ২২ বছর বয়সী ফুলমালা বাস করেন এই চরে। স্বামী শাহ আলম (৪১) ঢাকায় রিকশা চালান। ফুলমালা গ্রামের বাড়িতে একটি মুদির দোকান দেখাশোনা করেন। তার স্বামীর আরও দুই স্ত্রী আছে। ফুলমালা তিন নম্বর স্ত্রী। বর্তমানে ফুলমালার তিনটি সন্তান। বড় ছেলের বয়স সাত বছর, বড় মেয়ের বয়স পাঁচ বছর আর ছোট মেয়ের বয়স দুই বছর। ছোট মেয়ে চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। ফুলমালা নিজেও ভুগছে অপুষ্টিতে। রোগা লিকলিকে শরীর নিয়ে সন্তান ও দোকান কোনোটাই ঠিকমতো সামলাতে পারছেন না তিনি। আট বছর আগে ফুলমালার বিয়ে হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি, কীভাবে তিনি সন্তানদের লালনপালন করবেন। তার মতে, ‘গরিব মানুষ হওয়া ভালো নয়।’ ভালো ভালো খাওয়া যায় না, লেখাপড়া করার সুযোগ পাওয়া যায় না, আরও কত কিছুর সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে কি না, জানতে চাইলে ফুলমালাসহ আরও কয়েকজন নারী কিছু না বুঝে কিছু সময় তাকিয়ে থাকেন। কিছু বোঝেননি বলে তারা জানান। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং যৌন আচরণ সম্পর্কে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। যৌন আচরণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়াটা তাদের জন্য সহজ নয়। বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা কিশোরীর সন্তান প্রসবের আগে উন্নত মানের পরিচর্যা দরকার। আর তার প্রসবকালে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী বা সেবিকার সহায়তা প্রয়োজন। কারণ বয়স অল্প হওয়ায় কিশোরী মায়েরা বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ ক্ষেত্রে তার স্বামীরও প্রসূতির গর্ভকালীন বিভিন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি।

শিশুবিয়ের সংগে অল্প বয়সে প্রথম সন্তান জš§দানের সম্পর্ক রয়েছে। নারীদের প্রায় অর্ধেক ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। সর্বশেষ আদমশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা পাঁচ ভাগের এক ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের মেয়েরা, বিশেষত যারা গ্রামে বাস করে, কিংবা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত থাকে, তারা ছেলেদের তুলনায় দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং কিশোরী বয়সেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়। এমনকি অনেক কিশোরীর কেউ কেউ বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বিবাহিত এবং গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করেছে। এরই মধ্যে তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিয়েবিচ্ছেদও হয়েছে। আবার কেউ বিধবা হয়ে শিশুসন্তানদের দেখভাল করতে হিমশিম খাচ্ছে।             

ফুলমালার মতো এ দেশের অনেক কন্যাশিশুর বিয়ে হচ্ছে। ‘বিডিএইচএস ২০১৭’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরে উপনীত হওয়ার আগেই দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরীর বিয়ে হয় এবং এক-তৃতীয়াংশ কিশোরী এক সন্তানের জননী হয়। উল্লেখ্য, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিতদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার চাহিদা বেশি থাকলেও আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার খুবই কম। বাল্যবিয়ের কারণে ৮৬ শতাংশ কিশোরী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরিবারের ইচ্ছায় ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়। অশিক্ষা, অপুষ্টি, ভগ্নস্বাস্থ্য ও নির্ভরশীলতা বয়ঃসন্ধিকালীন বিয়ের অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ে মানে একজন কিশোরীর সব সম্ভাবনার সমাপ্তি। এসব পরিসংখ্যান বাংলাদেশে কিশোরীদের সার্বিক অবস্থা এবং নিজেদের সমাজ ও দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অনুকূল নয়।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারীর বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। গ্রামে এই হার ৭১ শতাংশ এবং শহরে ৫৪ শতাংশ। ‘চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে চলতি বছরে প্রকাশিত একটি জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার সঙ্গে শিশুবিয়ের সম্পর্ক আছে। ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হওয়া নারীদের ৮৬ শতাংশ নিরক্ষর। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, কিশোরী মায়েরা দ্বিতীয় সন্তানও আগেই নেয়। তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার ছেড়ে দেয়ার হারও বেশি। শিশু জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে কিশোরী মায়েদের অংশটি বাড়ছে। ১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া ৩২ লাখ ৭৮ হাজার শিশুর মধ্যে কিশোরী মায়েরা জš§ দিয়েছিল ২৬ শতাংশ। ২০১২ সালে জন্ম নেয়া ৩২ লাখ ৬২ হাজার শিশুর মধ্যে কিশোরী মায়েরা জন্ম দেয় ২৯ শতাংশ।

দেশে প্রচলিত ‘শিশুবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯’ সংশোধন করা হয় ১৯৮৪ সালে। আইন অনুযায়ী পুরুষের বিয়ের বয়স ২১ বছর, নারীর ১৮ বছর। ব্যতিক্রম হলে বিয়ের সঙ্গে জড়িত বর-কনের অভিভাবক, আত্মীয়, স্থানীয় কাজিসহ সবার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। জড়িত পুরুষদের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড, অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয়দণ্ড হতে পারে। বর ও কনে দুজনই নাবালক হলে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বর সাবালক ও কনে নাবালিকা হলে ছেলের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড, অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের চলমান কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে হবে। তৃণমূলে ও প্রান্তিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেবার পাশাপাশি জনসচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বাল্যবিয়ে রোধকল্পে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নারীবান্ধব সমাজ গঠনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রমের প্রচলন করা প্রয়োজন। যেসব কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। ‘আঠারোর আগে বিয়ে নয়, বিশের আগে সন্তান নয়’ এই সেøাগানে সবাইকে একত্রিত করতে হবে।

শিশুবিয়ে একটি সামাজিক সমস্যা এবং এর জন্য অভিভাবকের অসচেতনতাকে দায়ী করা যায় বেশি। যেসব পরিবারে শিশুবিয়ে হয়, সেসব পরিবারে দাম্পত্যকলহ লেগেই থাকে। এর ফলে বহুবিয়ের হার বৃদ্ধি পায়। আমাদের কিশোর-কিশোরীদের বিরাট অংশ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং এর অধিকার সম্পর্কে জানে না। আবার অনেকে জানলেও সঠিকভাবে জানে না। তাই বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। কেননা মেয়েরা শিক্ষিত হলে তারা বিষয়গুলো জানতে ও বুঝতে পারবে, দেরিতে বিয়ে করবে। তারা তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুবিয়ে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া খুব জরুরি এবং তা এখনই। প্রজনন স্বাস্থ্যের যতœ ও শিশুবিয়ে রোধ খুবই যৌক্তিকভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০