বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের মাধ্যমে মানুষ প্রবেশ করেছে নতুন জীবনধারায়। তাই সনাতন জীবন ব্যবস্থা প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বে খুবই বেমানান। গত এক শতাব্দীতে ক্রমাগত বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সমগ্র পৃথিবী পরিণত হয়েছে একটি ছোট্ট গ্রামে। তবে এই আমূল পরিবর্তন এক দিনে সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু প্রজন্মের মানুষের চিন্তাধারা, গবেষণা ও কঠোর অধ্যবসায়ের ফলাফল আজকের এ প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে জন্ম নেয়া মানুষকে বিভিন্ন প্রজন্মের ভাগ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সব দুঃখ-দুর্দশা দূর করার মাধ্যম হিসেবে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চিন্তা যারা করেছিল তাদের বলা হয় বেবি বুমারস। এসব বেবি বুমারসরা মূলত নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে সামাজিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। বর্তমান সময়ে বেবি বুমারসদের কেই পৃথিবীতে অভিভাবক মনে করা হয়। তাদের সেই উদ্ভাবিত প্রযুক্তির উত্থান ও কার্যকারিতা যারা প্রত্যক্ষ করেছে তাদের বলা হয় জেনারেশন এক্স বা জেনেক্স। তারাও প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। তাদের হাত ধরেই সফটওয়্যার উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও নিয়মতান্ত্রিক প্রযুক্তি নির্ভর প্রশাসনের উদ্ভব ঘটে। জেনেক্সের উদ্ভাবিত আইটি সেক্টরের প্রতিনিধিত্ব করে জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালস। তাদের জন্ম আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও ডিজিটাল সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি, সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে মিলিনিয়ালসরা সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জেনারেশন ওয়াই এর পরে আসে ডিজিটাল নেটিভ প্রজš§ বা জেনারেশন জেড। স্মার্ট প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় এই জেনারেশনের দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ববর্তী সব প্রজন্ম থেকে ভিন্ন এবং কিছুটা সাংঘর্ষিক। প্রযুক্তির অপব্যবহার ও দৈনন্দিন জীবনে অত্যধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে তারা পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া স্থাপন করতে পারেনি। পূর্ববর্তী প্রজন্মের লালিত মূল্যবোধ বর্তমান প্রজন্মেরমধ্যে ফলপ্রসূভাবে স্থানান্তরিত হচ্ছে না। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্বশীল আচরণ বর্তমান প্রজšে§র কাছে ব্যক্তিগত জীবনে অহেতুক ও অযাচিত হস্তক্ষেপ মনে হয়। অপরদিকে একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্মের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তচিন্তা আগের প্রজন্মের কাছে সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিকতা পরিপন্থি। এভাবেই তৈরি হচ্ছে প্রজন্ম দূরত্ব বা জেনারেশন গ্যাপ। প্রজন্মের দূরত্ব তৈরি হয় পূর্ববর্তী প্রজন্ম বর্তমান সময়ের পরিবর্তন সমূহ প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যা আগামী দিনের উদ্ভাবনকে নিঃসন্দেহে হুমকিতে ফেলবে। পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় অনেকে নিজেদের তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। ফলে তাদের মধ্যে কাজ করছে একাকীত্ব ও অবসাদ। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ও পরবর্তী আলফা প্রজন্মের জন্য সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা সবার দায়িত্ব। এর জন্য বর্তমান প্রজš§কে মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে হবে এবং পূর্ববর্তী প্রজšে§র প্রযুক্তিগত বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে প্রযুক্তির সঙ্গে সর্বজনীন সম্পর্ক। শুধু মানুষ ও প্রযুক্তির অংশীদারত্বের মাধ্যমেই প্রজন্মগুলোর মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা সম্ভব। তাই প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করে জটিল সমস্যা মোকাবিলা করে সামষ্টিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
সব প্রজন্মের মেলবন্ধনে উম্মোচিত হতে পারে নতুন দিগন্ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে বিস্তর ধারণা প্রজন্ম গুলোর মধ্যে একটি গতিশীল সহাবস্থান তৈরি করতে পারে। তাই মানুষ ও প্রযুক্তির অংশীদারিত্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। যার মাধ্যমে আমাদের সৃজনশীলতাকে প্রসারিত করে সবাই একত্র হয়ে বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত হওয়া যাবে। নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও প্রযুক্তির সম্ভাবনা জেনারেশন গ্যাপ দূর করে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা উম্মোচন করবে। বিকশিত করবে নতুন প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা। তাহলেই জেনারেশন আলফার জন্য সৃষ্টি হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি সুন্দর ও আলোকিত পৃথিবী।
কাজী খবিরুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়