প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কি নিজেদের জনগণের সেবক ভাবেন?

সুকান্ত দাস: গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। দেশের শাসনভার কার হাতে থাকবে তাও জনগণই ঠিক করে দেয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে মনে হচ্ছে, যার টাকায় জমিদারি, তারই ওপর ঘোরায় ছড়ি। যেন এমনই হচ্ছে চারদিকে।

দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের অবস্থা খুবই খারাপ। নির্দিষ্ট শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হলেও সব জায়গায় কয়েক হাজার রোগী থাকেন। হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে হাঁটা যায় না রোগীর ভিড়ে। কিন্তু এই অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। প্রায়ই দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার সংকট আছে। কারণ নির্দিষ্ট সংখ্যা রোগীর জন্য নির্দিষ্ট ডাক্তার দেয়া হলেও আদতে রোগী অনেক ভর্তি হয়। এ কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। দেশের ধনবান মানুষ এবং রাজনীতিবিদেরা চিকিৎসা নিতে বাইরের দেশে যেতে পারলেও রাষ্ট্রের মালিক সাধারণ জনগণকে চিকিৎসা নিতে হয় ওই সরকারি হাসপাতালের অপরিষ্কার বারান্দায় শুয়ে। সরকারি হাসপাতালের কর্মচারীদের নিয়েও অনেক অভিযোগ আছে সাধারণ মানুষের। এছাড়া অনেক সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে টিকিটের দাম বেশি নেয়া হয়। এ বিষয়ে সব জায়গায় ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। তবে কভিডের আগে বাগেরহাট সরকারি হাসপাতালে পরিচয় গোপন করে মুখ চাদরে ঢেকে টিকিট কিনতে যান বাগেরহাট ২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ তš§য়। টিকিটের দাম বেশি নেয়ার কারণে তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেন। কিন্তু সব জায়গায় এমন তদারকি করা হয় না। যার ফলে সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি হয়।

বর্তমান সরকারের রূপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বের ১১৯তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কোনো দেশ হিসেবে বাংলাদেশ

ই-পাসপোর্ট যুগে প্রবেশ করেছিল ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি। ধারণা করা হয়েছিল জনগণের ভোগান্তি লাঘব হবে। দালাল চক্রের হাত থেকে মুক্তি পাবে সেবাগ্রহীতারা। কিন্তু তা আর হলো কই। দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেক্টরগুলোর মধ্যে অন্যতম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসগুলো। পাসপোর্ট অফিসে কর্মকর্তারা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে প্রায়ই বাজে ব্যবহার করে। তাদের জন্যই জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের কারণে মানুষ বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। কর্মকর্তাদের সেবাদানের মনোভাব নেই বললে চলে। ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গড়িমসি অবৈধ কিছুর দিকে ইঙ্গিত বহন করে। বিভিন্ন সময়ে দেশের অনেক পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা অধিকাংশই দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িত। চুয়াডাঙ্গা পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকের ঘুষ চাওয়ার ভিডিও তো অনেক সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা জনগণের ভোগান্তি লাঘব করতে চাইলেও আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তাদের সেই ইচ্ছা একদমই নেই বললেই চলে। সরকার অনেকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু কিছু সংখ্যক অসাধু মানুষের জন্য জনগণ উপযুক্ত সুবিধা পাচ্ছে না।

জনগণের ভোগান্তির আরেকটা জায়গা হলো ভূমি অফিস। ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতি ও হয়রানির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঘুষ ও তদবির ছাড়া এই অফিসে কোনো সেবা পাওয়া মুশকিল। দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালাল চক্রের যাঁতাকলে পড়ে সেবা প্রার্থীরা একদম অসহায়। বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতি চলছে প্রকাশ্যে। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

ঘুষ দিয়ে খাস জমি, পরিত্যক্ত জমি বা অর্পিত সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নিচ্ছে এলাকার প্রভাবশালীরা। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় এক দুর্ভেদ্য দালাল চক্রে আবদ্ধ অধিকাংশ ভূমি অফিস।

জনগণের টাকায় বেতন পাচ্ছে, সবরকম সুবিধা পাচ্ছে কিন্তু সেই জনগণকেই সর্বদা অবজ্ঞা, অসম্মান করছে এবং ভোগান্তিতে ফেলছে। আইন অনুযায়ী এরা জনগণকে সব সেবা দিতে বাধ্য। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দেয়া হয় এই সেবা দেয়ার জন্যই। কিন্তু তারা এসবের ধার ধারে না। অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনে মত্ত তারা। আর দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

যদি প্রশ্ন করা হয় শিক্ষাব্যবস্থা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো কাদের জন্য? স্বাভাবিকভাবেই উত্তর আসবে শিক্ষার্থীদের জন্য। রাষ্ট্রের মালিক যেমন জনগণ তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা শিক্ষার্থীরা। সেখানের যা কিছু আছে সবই তাদের জন্য। বড়বড় ভবন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, পরিবহন ব্যবস্থা সবকিছুই শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন অবস্থা। এখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেন কোনো কর্তৃত্ব নেই। কর্মকর্তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে। শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে না। শিক্ষার্থীরা কোনো কাজে গেলে অহেতুক কালক্ষেপণ করে। আড্ডা এবং গল্প করে সময় নষ্ট করে। অন্য দিকে সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলীর একমাত্র কাজ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা এবং গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষক ঠিকমতো ক্লাস নেন না, নামে মাত্র ক্লাস নেয়, গবেষণা করে না বা ছাত্রদের গবেষণায় সাহায্য করে না। তারা শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে। নিয়মিত ছাত্রদের ক্লাস ঠিকমতো না নিলেও কিছু শিক্ষক টাকার জন্য সান্ধ্যকালীন ক্লাস নেন নিয়মিত। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও এই কাজের সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু তারপরও এদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ আবাসিক সুবিধা নেই এবং শিক্ষার্থীরা বাইরে থাকে সেখানে তাদের পরিবহন ব্যবস্থাও কর্মকর্তা কর্মচারীদের তুলনায় অনেক খারাপ। আবাসিক হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ না হয়ে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের ইচ্ছায় সিট বরাদ্দ হচ্ছে।

যে শিক্ষার্থীদের জন্য সবকিছু, সেই শিক্ষার্থীদেরই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং তাদের ব্যবহার করে সুফল ভোগ করছে একটা গোষ্ঠী। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। ফলে রাষ্ট্রের সব কর্মচারী জনগণের সেবক হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা কোথাও দেখা যায় না। অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের জমিদার ভাবতে পছন্দ করে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখেছি করোনাকালীন নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার ইউএনওকে স্যার না বলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ওপরে ক্ষেপে যান স্থানীয় থানার ওসি। ওই শিক্ষার্থী তো দেশের নাগরিক, দেশের নাগরিকদের টাকায় সরকারি কর্মচারীরা বেতন পায়। তাহলে নিয়ম অনুযায়ী ইইএনও বা ওসির উচিত ওই শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ মানুষকে স্যার বলা।

গত বছর জুলাইয়ের মাঝামাঝি একাধিক পত্রিকার শিরোনাম ছিল মিনিটে ১৬ বার ‘স্যার’ বলেন ভারতীয় আমলারা। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়, ভারতের একজন আমলা এক-দুবার নয়, মিনিটে ষোলোবার ‘স্যার’ বলেন। ‘পলিসিমেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি’ নামে একটি স্মৃতিচারণমূলক বইতে তিনি নিজের চোখে দেখা ভারতীয় আমলাদের কিছু পছন্দ-অপছন্দ ও প্রথা সম্পর্কে বিশদ তুলে ধরেন। প্রতিবেশী দেশের আমলাদের এমন গল্প শোনার পর দেশের সরকারি কর্মচারীরা কি ভাবছেন, তা তারাই জানেন। কিন্তু গণকর্মচারীরা জনগণকে কী বলে সম্বোধন করবেন সে বিষয়ে আইন সংশোধনের দরকার। উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীরা সেবা নিতে যাওয়া জনগণকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। শুধু ডিজিটাল হলেই হবে না, দেশের মালিকের প্রতি আচার-আচরণের দিকটিও খেয়াল রাখতে হবে। যাদের দেয়া করের টাকায় বেতন পাচ্ছেন তাদের উপযুক্ত সম্মান দেখানো অত্যন্ত জরুরি। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো এগুলো যারা করে তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তাদের থেকে এমন আচরণ কখনোই কাম্য নয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া।

একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দামি মানুষ হলো সেই দেশের কৃষকেরা। কারণ তারা সমগ্র দেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়। পরনের বস্ত্র তৈরি করে দেয়। কৃষকেরা সর্বজন পূজনীয়। তাদের ছাড়া দেশের অগ্রযাত্রা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, কৃষকদের অবজ্ঞা, অসম্মান করতে। চেক প্রতরণা সংক্রান্ত এক মামলায় সম্প্রতি ২৫ হাজার টাকা ঋণখেলাপির ঘটনায় পাবনার ১২ কৃষককে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, এই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না। কিন্তু এই কৃষকদের সামান্য কারণে জেল হাজতে রাখা হলো।

কৃষকেরা সারাজীবন কষ্ট করে যায় আর লাভবান হয় মধ্যস্বত্ব ভোগী দালাল এবং ব্যবসায়ীরা। দেশে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও প্রতিনিয়ত চালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মধ্যে একটি অসাধু ব্যাবসায়ী এবং মিল মালিক চাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা কারসাজি করে নিজেদের লাভের জন্য এসব করছে। ফলে কৃষকপর্যায়ে ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কাগজে কলমে কৃষক সমাজের উন্নতির কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা। বিভিন্ন সমস্যার এবং অসাধু মানুষের কারণে আমাদের সরল সহজ কৃষক সমাজ অসহায়।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংকট কাটিয়ে চলছে দেশের অগ্রযাত্রা। কিন্তু কিছু দুর্নীতিবাজ মানুষ এই অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। সেজন্য তারা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাক্ষেত্রে, সরকারি হাসপাতালে, ভূমি অফিসে, পাসপোর্ট অফিসে, রাষ্ট্রের কর্মচারীদের থেকে প্রতিনিয়ত প্রাপ্য সেবা পাচ্ছে না জনগণ। সরকার বহুভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে জনগণের ভোগান্তি লাঘব হয়। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষের কারণে তা হয়ে উঠছে না। যার দায় যাচ্ছে সরকারের ওপর। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষ তাদের প্রাপ্য সেবা পাচ্ছে না কর্মচারীদের থেকে। এ বিষয়ে সরকারের উচিত এখনই যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেয়া। তবে সরকারের কাজ আরও সহজ হবে যদি সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হয়।

শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০