প্রণোদনার ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার গ্রাহকের

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইন অনুযায়ী ঋণ নিয়ে এক খাতের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করা গুরুতর অপরাধ। তারপরও সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যয় করেছেন আইএফআইসি ব্যাংকের একাধিক গ্রাহক। ব্যাংকের তিন শাখায় ৮৩ কোটি টাকা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার মতো অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন শাখা, গুলশান শাখা ও নারায়ণগঞ্জ শাখার মাধ্যমে ৮৩ কোটি টাকার অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এসব শাখা থেকে বিতরণকৃত প্রণোদনা ঋণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রণোদনার ঋণ বিতরণের সময় বড় গ্রুপগুলোকে তাদের নেয়া আগের ঋণের সুদ পরিশোধ ও ঋণ সমন্বয় করার প্রবণতা লক্ষ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার বিষয়টিও একাধিক ব্যাংকে পরিদর্শনের সময়ে চোখে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন শাখা ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রণোদনা তহবিল থেকে চলতি মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) হিসাবে আনোয়ার সিমেন্ট লিমিটেডকে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিতরণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে এ ঋণের টাকা নিয়ে আনোয়ার সিমেন্ট অন্য ব্যাংকের ঋণ সমন্বয় করেছে। শুধু তা-ই নয়, আনোয়ার সিমেন্ট প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে নেয়া ঋণের এক কোটি টাকা রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টের (আরটিজিএস) মাধ্যমে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছে। এছাড়া আনোয়ার সিমেন্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনোয়ার ইস্পাতের ট্রাস্ট ব্যাংকের হিসাবে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা জমা করে।

আরটিজিএস হলো একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিকভাবে বা প্রকৃত সময়ে তহবিল স্থানান্তর করা যায়।

প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে স্বল্প সুদের ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ সমন্বয় করেছে আনোয়ার সিমেন্ট। এ দুটি প্রক্রিয়া মাত্র দুই দিনে প্রতিষ্ঠানটি সম্পন্ন করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

ব্যাংকটির ফেডারেশন শাখা উত্তরা স্পিনিং মিলস লিমিটেডকে সাত কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। বঙ্গো মিলার্স লিমিটেডকে দেয়া হয় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া স্বল্প সুদের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বঁঙ্গো বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস লিমিটেডকে সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ডিউরেবল প্লাস্টিক লিমিটেডকে দেয়া হয় চার

 কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোট ২০ কোটি ৯০ লাখ টাকা কোম্পানিগুলোকে চলতি মূলধন ঋণ দেয় আইএফআইসি ব্যাংক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণ করা এসব ঋণ কোম্পানিগুলো তাদের অন্যান্য ব্যাংকের হিসাব নম্বরে স্থানান্তর করেছে। এর কারণে প্রণোদনা ঋণের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না, তা জানতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকেও এমন অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। প্রণোদনা তহবিল থেকে এসকিউ সেলসিয়াস লিমিটেডকে ১০ কোটি টাকা এবং সোনিয়া অ্যান্ড সোয়েটারস লিমিটেডকে পাঁচ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটির গুলশান শাখা।

পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, এ শাখা থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া মোট ১৫ কোটি টাকা অন্যান্য ব্যাংকে থাকা আগের ঋণ সমন্বয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে দেয়া ঋণ অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয় ঋণ পরিশোধের জন্য, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রণোদনা ঋণ পাওয়ার পর এসকিউ সেলসিয়াস লিমিটেড ঋণ সমন্বয় করতে বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করে। সোনিয়া সোয়েটারস লিমিটেডের শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি দেয়ার শর্তে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিলেও শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে এ ঋণ ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পায়নি পরিদর্শক দল।

আইএফআইসি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় রনি নিট কম্পোজিট লিমিটেডকে এক কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং নিট কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিটকে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চলতি মূলধন ঋণ দেয় হয়। এ অর্থের মাধ্যমে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে বলে জানায় কোম্পানি দুটি। তবে এ টাকা দিয়ে বেতন পরিশোধের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল।

এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শাহ এ সারওয়ারের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে কল ও মেসেজ দিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ মো. মঈনুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণোদনা ঋণ বিতরণের বিষয়ে আমাদের ব্যাংকে একটি অডিট করেছে, তবে কোনো অনিয়ম পেয়েছেÑএমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। জানামতে, আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে কোনো অনিয়ম হওয়ার কথা নয়।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রণোদনা তহবিলের ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন চলমান। যদি কোনো ব্যাংক অনিয়ম করে তাহলে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংগুলো যদি প্রণোদনার ঋণের শর্ত পূরণ না করে, তাহলে সরকার ঘোষিত সুবিধা বাতিল হবে বলেও জানান তিনি।’ সুতরাং এসব ঋণের বিপরীতে সুদ হারের অর্ধেক দেয়ার কথা ছিল সরকারের। সে সুদের ভর্তুকি বাতিল করা হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ-উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রণোদনা ঋণ বিতরণে অনিয়ম হয়েছে। কিছু বড় ঋণগ্রহীতা পূর্ববর্তী ঋণ সমন্বয় করার জন্য স্বল্প সুদের প্রণোদনা তহবিল ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ তহবিলের সঠিক ব্যবহার হয়নি। তিনি আরও বলেন, স্বল্প সুদের প্রণোদনা তহবিলের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি আরও জোরদার করা উচিত।

করোনা মহামারি চলাকালে দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, সে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। প্রণোদনার আওতায় ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এ ঋণের মোট সুদের অর্ধেক সরকার পরিশোধ করবে বলে ঘোষণা করা হয়।

বৃহৎ শিল্প এবং সেবা খাতের জন্য ঘোষণা করা হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণের আওতায় ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন হিসাবে বিতরণ করে। ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে গ্রাহক দেবে চার দশমিক পাঁচ শতাংশ। বাকি অর্ধেক, অর্থাৎ চার দশমিক পাঁচ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় জানানো হয়। এ সুযোগের অপব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন গ্রুপ এবং ব্যাংকের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দেয়া ঋণের ওপর তদারকি করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশে বলা হয়, ঋণঝুঁকি কমাতে সঠিকভাবে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ও ঋণগ্রহীতাদের ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে। দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি আকারে এ নির্দেশনা জারি করা হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০