শরীফুল ইসলাম ইন্না, সিরাজগঞ্জ: দেশের বিভিন্ন জেলায় হাঁস-মুরগির নতুন রোগ দেখা দিয়েছে। এতে মারা যাচ্ছে খামারের বহু মুরগি। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (এইচ৫এন৮) বা বার্ড ফ্লু-৯ নামের এই ভাইরাসের সংক্রমণে সিরাজগঞ্জের পোলট্রি শিল্পে ধস নেমেছে। জেলার বেশ কয়েকটি খামারে হাজার হাজার মুরগি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ রোগটি নতুন হওয়ায় খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অন্য মুরগিতে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় ভয়ে অনেকে আক্রান্ত মুরগি মাটিতে পুঁতে রাখছেন, আবার কেউ বিক্রি করে খামার খালি করে দিচ্ছেন। এতে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারিদের। তবে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুরগির এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাসের বিষয়টি তাদের অজানা। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। জীবিত, মৃত ও অসুস্থ মুরগি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সিরাজগঞ্জ পোলট্রি খামার মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, জেলায় আশির দশকের শুরুতে পোলট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন সময় চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এখানে গড়ে ওঠে প্রায় পাঁচ হাজার পোলট্রি খামার। ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু এবং বন্যার কারণে সিরাজগঞ্জ জেলায় পাঁচ হাজার খামারের প্রায় অর্ধেক বন্ধ রয়েছে।
শিক্ষিত কর্মহীনরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং বন্যায় সবকিছু হয়ে যায় লণ্ডভণ্ড। এখন এলাকার পোলট্রি শিল্প ধ্বংসের দোরগোড়ায়। বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারে এখন মানুষের বসবাস। বর্তমানে নতুন করে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু¬-৯-এর কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন খামার মালিকরা। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে মরে যাচ্ছে খামারের মুরগি। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা।
সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের ক্ষুদ্র শিয়ালকোল গ্রামের খামারি কবির হোসেন বলেন, আমার খামারের মুরগি কয়েক দিন আগে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু-৯-এ আক্রান্ত হয়। এতে বেশ কিছু মুরগি মারা যায়। এ কারণে খামারের অর্ধেক মুরগি বিক্রি করে দেয়া হয়। কিছু মুরগি খামারে আছে। এগুলো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া বাদ দিলে মুরগি মারা যায়। সঠিক ট্রিটমেন্ট এখনও পাচ্ছি না। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা পরামর্শ দিচ্ছে, কিন্তু কোনো পরামর্শ কাজে লাগছে না। তিনি জানান, খামারে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুরগি ছিল। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৫-২০টি মুরগি মারা যায়। মুরগি মারা যাওয়ার ভয়ে বিক্রি করে দেয়ায় লোকসান গুনতে হয়েছে।
বিলধলী গ্রামের খামারি আব্দুস সামাদ বলেন, এক বছর আগে আমি নতুন খামার করেছি। আমার খামারে এক হাজার ১০০ মুরগি ছিল। এর মধ্যে ৬০০ মুরগি বিক্রি করে দেয়া হয়। বাকি মুরগি মারা গেছে। এক বছরের মধ্যে আমি প্রায় ছয় লাখ টাকার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বার্ড ফ্লু-৯ এ আক্রান্ত হয়ে আমার মুরগি মারা গেছে। ওষুধ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
ক্ষুদ্র শিয়ালকোল গ্রামের হাফিজুল ইসলাম বলেন, তিন বছর আগে খামার তৈরি করি। খামারে এক হাজার ১০০ মুরগি ছিল। ১০ মাস আগে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে আমার খামারের প্রায় সব মুরগি মারা যায়। এতে প্রায় সাত লাখ টাকা লোকসান হয়। এখন ব্যাংকঋণের জন্য আবেদন করছি। ব্যাংকঋণ পেলে খামারে মুরগি তুলতে পারব। তিনি বলেন, বার্ড ফ্লুতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারিভাবে খামারিরা আর্থিক সহায়তা পেলে ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।
সিরাজগঞ্জ পোলট্রি খামার মালিক সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর পদকপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজুর রহমান বলেন, মুরগির বার্ড ফ্লু রোগটি শীতকালে বেশি হয়। একসময় বার্ডফ্লু-৫ ছিল, এখন রূপ পরিবর্তন করে বার্ড ফ্লু-৯ হয়েছে। টিকাও কাজ করছে না। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খামারিরা। বিশেষ করে সুচিকিৎসার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে বেশি। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের কাছে বার্ড ফ্লুর প্রতিকারের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার বলেন, খামারগুলোয় সব সময় মনিটরিং করা হচ্ছে। খামারিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ডফ্লু-৯-সংক্রান্ত তথ্য আমার কাছে আসেনি। এরকম যদি তথ্য থাকে তাহলে জীবিত, মৃত ও অসুস্থ মুরগি আমাদের প্রাণী রোগ অনুসন্ধান কেন্দ্রে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে মুরগি কোন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ শীতকালে খামারিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে মুরগি রাখেন। থাকা ও রাখার ব্যবস্থা খারাপ হতে পারে। আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলতে পারব কী কারণে মুরগি মারা যাচ্ছে।