ইসমাইল আলী: চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহে রয়েছে প্রচুর ঘাটতি। এজন্য শিল্পোৎপাদন ব্যাহত ছাড়াও আবাসিক গ্রাহকদের ভোগান্তির শেষ নেই। এরপরও আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে প্রচুর গ্যাস। অদক্ষ ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি এর মূল কারণ। এতে দৈনিক সরবরাহ করা গ্যাসের ১৬ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রণীত ‘এনার্জি সিকিউরিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জ্বালানি সম্পদ বিভাগে জমা দেয় এডিবি। এতে বলা হয়, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট অপচয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অপচয়ের হার বেশি। এছাড়া আবাসিকেও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। অপচয় বন্ধ করা গেলে এ গ্যাস দ্বারা তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সর্ববৃহৎ গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের এলাকাতেই অপচয় হচ্ছে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে আবাসিক এলাকায় অপচয় হচ্ছে ১০০ মিলিয়ন ও শিল্পে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আবাসিকে অপচয়ের মূল কারণ দুটি। এগুলো হলো- নিন্মমানের চুলার ব্যবহার ও গ্রাহকদের অসতর্কতায় অপ্রয়োজনে চুলা জ্বালিয়ে রাখা। আর শিল্পে অপচয়ের কারণ নিম্নমানের ও পুরোনো বয়লার-যন্ত্রপাতি ব্যবহার।
এদিকে দেশের সার কারখানাগুলোতে অপচয় হচ্ছে গড়ে ৭৬ শতাংশ গ্যাস। এক্ষেত্রে দেশে প্রতি টন ইউরিয়া উৎপাদনে ৪৪ হাজার ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ২৫ হাজার টন। এর বাইরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি দক্ষতা (এনার্জি ইফিশিয়েন্সি) বিষয়ের গবেষক ইজাজ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, জ্বালানি অপচয়ের বিষয়টি দীর্ঘদিন একেবারে অবহেলিত ছিল। যুগের পর যুগ অদক্ষ যন্ত্রপাতি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় করা হয়েছে। এখন জ্বালানির সংকট দেখা দেওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিছুু কাজও শুরু হয়েছে। বেসরকারি খাতের অল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছে। সরকারও তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। তবে সরকারি খাতে দক্ষতা উন্নয়নে বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে শিল্প-কারখানায় জ্বালানি ব্যবহারে ৩১ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপচয় হচ্ছে টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্ট শিল্পে। এরপর রয়েছে সার এবং স্টিল ও রি-রোলিং শিল্প। এছাড়া সিমেন্ট, কোল্ডস্টোরেজ, কেমিক্যাল ও অন্যান্য শিল্পেও প্রচুর গ্যাস অপচয় হচ্ছে। এসব শিল্পে গ্যাস ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ানো গেলে বছরে প্রায় তিন দশমিক ছয় মিলিয়ন টন জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব হবে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসে।
তথ্যমতে, বর্তমানে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাতে ৩০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করা হয়, যা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশে আনা যাবে। অর্থাৎ ১২ দশমিক ৪ শতাংশ গ্যাস সাশ্রয় হবে এ খাতে। এরপর রয়েছে কেমিক্যাল ও সার উৎপাদনে। এক্ষেত্রে খাতটিতে বর্তমানে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ৮ দশমিক ৪ শতাংশ গ্যাস দিয়েই এ সার উৎপাদন সম্ভব। অর্থাৎ সাশ্রয় হবে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ গ্যাস। স্টিল ও রি-রোলিং খাতে বর্তমানে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করা হয়। দক্ষতা বাড়ানো গেলে এটিকে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। এতে খাতটিতে ১ দশমিক ৯ শতাংশ গ্যাস অপচয় হচ্ছে।
এদিকে বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সিঙ্গেল সাইকেল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এগুলোর গ্যাস ব্যবহার দক্ষতা মাত্র ২৩-৩০ শতাংশ। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করা গেলে দক্ষতা বাড়িয়ে ৫০-৫৫ শতাংশে উন্নীত করা যাবে। এ গ্যাস দিয়ে অতিরিক্ত ২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
অধ্যাপক ইজাজ বলেন, কারখানাগুলোর প্রযুক্তি পরিবর্তন করে এ অপচয় বন্ধ করা যায়। কাফকো পাঁচ বছর আগে তিন কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় করে কারখানার আধুনিকায়ন করেছে। তা না-হলে তো তারা লাভজনক হতে পারত না। আর তাদের তো আন্তর্জাতিক দামে গ্যাস কিনতে হয়। তবে দেশি সার-কারখানা তো কম দামে গ্যাস পায়। ফলে জ্বালানির অপচয় নিয়ে এদের মাথাব্যথা কম। কিন্তু এতে জ্বালানি খাতের এবং দেশের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র রি-পাওয়ারিং (পুনক্ষমতায়ন) ও কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে পাঠানো হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে। আর ইউরিয়া উৎপাদনেও গ্যাসের ব্যবহার কমাতে নতুন সার-কারখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পুরোনোগুলো অবসরে পাঠানো হবে।
Add Comment