নিজস্ব প্রতিবেদক: শিল্প খাতে গত অর্থবছরে মেয়াদি ঋণ বিতরণে বড় প্রবৃদ্ধি হলেও, তার প্রতিফলন নেই মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির চিত্রে। ফলে শিল্প খাতে নেয়া ঋণের সদ্ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া শিল্পের মেয়াদি ঋণের অর্ধেকেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্পের মেয়াদি ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩১ শতাংশ। এ সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বাড়লে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। যদি সেটা না হয়, তাহলে ঋণের যথাযথ ব্যবহার হওয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এক্ষেত্রে ঋণের একটা অংশ বিদেশেও পাচার হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খতিয়ে দেখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ ও আদায় দুই-ই বেড়েছে। এ সময়ে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে এই খাতে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি। এ সময়ে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ হয়েছে ৯৫ হাজার ১৭২ কোটি টাকা, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩১ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আর চলতি মূলধন বিতরণ হয়েছে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ শুধু শিল্পে মেয়াদি ঋণই নয়, চলতি মূলধন ঋণও এ খাতে বেড়েছে। কিন্তু এই ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির চিত্রে তার কোনো প্রতিফলন নেই। শিল্প স্থাপনের জন্য অপরিহার্য এই পণ্যটির আমদানি গেল অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ডলারের। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমার পেছনে অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ডলার সংকট এবং রিজার্ভ সাশ্রয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপও।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, সাধারণত শিল্পে মেয়াদি ঋণ বিতরণ বাড়লে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এখন আলোচ্য ঋণ যদি যথাযথ ব্যবহার না হয় বা তহবিল অন্য জায়গায় স্থানান্তর হয় তাহলে উল্টো চিত্র হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে অর্থ পাচারের আশঙ্কা করছেন কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণসহ অন্য ঋণও বাড়ছে। কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাহলে ঋণের অর্থ কোথায় যাচ্ছে? বিষয়টি ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের খতিয়ে দেখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত অর্থবছরে বেসরকারি, বিদেশি ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ বেড়েছে। তবে ঋণ বিতরণ কমে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল অর্থবছরে শিল্প খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭৭ হাজার ১৮০
কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর বিতরণের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৩ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এ সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে ৩ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গেল অর্থবছর শেষে শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে ৫৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। এর মানে এক বছরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশ। মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ সবচেয়ে বেশি রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে। গত অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৯৩০ কোটি টাকায়। সরকারি ব্যাংকে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬৫০ কোটি, বিদেশি ব্যাংকে ৩৪০ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকে ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ৮ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, গত অর্থবছরে শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে হয়েছিল ৬৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ঋণ আদায় বেড়েছে ৪১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন শেষে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩২০ কোটি টাকায়। ২০২২ সালের জুন শেষে যা ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ৪১০ কোটি টাকা।