Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 5:15 am

প্রতিবছর এক ডিগ্রি করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি নদী-খাল-বন নষ্টের ফল

ফারুক আলম, লালমনিরহাট: বৈশ্বিকভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে। এ বছর দেশে ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙে দাবদাহ দেখেছে দেশবাসী। চলতি বছরে সব থেকে আলোচিত শব্দ ‘দাবদাহ’। রংপুর বিভাগের আবহাওয়া দপ্তরের গত তিন বছরের এপ্রিল ও মে মাসের তাপমাত্রার রেকর্ডে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়েছে। গত তিন বছরে প্রতি বছর এক ডিগ্রি করে তাপমাত্রা বেড়ে মোট চার ডিগ্রি বেড়েছে।

আবহাওয়া দপ্তর সূত্র জানায়, ২০২০ সালের এপ্রিলে ৩৫ দশমিক ২ ও মে মাসে ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ৪ এবং মে মাসে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ৩৬ দশমিক ৪ এবং মে মাসে ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ৩৯ দশমিক ২ এবং মে মাসে ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এ বছর এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি। তিন বছরের হিসাব ধরলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৩ সালের হিসাব ধরলে আরও এক ডিগ্রি বেশি বেড়েছে।

তাপমাত্রা বাড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য দেশি গাছ রোপণের কথা বলা হচ্ছে। তবে এই পরামর্শ মাঠ পর্যায়ে টেকসই হচ্ছে না। একদিকে ঝিমিয়ে পড়া বৃক্ষরোপণ আন্দোলন, অন্যদিকে থেমে নেই বাসাবাড়িতে ব্যক্তিমালিকানায় থাকা গাছসহ সরকারি প্রকল্প সম্প্রসারণে পুরোনো গাছ কাটা।

অন্যদিকে নদী মরেছে সমান তালে। লালমনিরহাট জেলায় স্বর্ণামতী, সিঙ্গিমারি, সাকওয়া, সানিয়াজান, সাতানোয়া, বুড়িতিস্তা, সতী, রতনাই, ভাটেশ্বর, ধরলা, দেউলা, ত্রিমোহনী, চেনাকোনা, গিদারি, খাপরা, খানা, খাটুমারা, সাঙ্গলি ও ছিনাকাটা নদীতে স্বাভাবিক প্রাণ নেই। বিলগুলো শুকিয়ে ভরাট হয়েছে। বেশিরভাগ খালের কোনো অস্তিত্ব নেই।

এর পাশাপাশি কুড়িগ্রাম ও রংপুরের বেশ কিছু নদীতে কোনো পানিপ্রবাহ নেই। কুড়িগ্রামের বারোমাসি নদীতে কোনো পানি নেই।

রংপুরের জগদীশ চন্দ্র বলেন, আমরা কিশোর বয়সে শ্যামা সুন্দরী খালে গোসল করতাম। আকারে ছোট নৌকায় করে আমরা মাছ ধরেছি। এখন সেই খালে মরা প্রাণীসহ মলমূত্র ফেলে খালটি ধ্বংস করা হয়েছে। চাররপাশ থেকে দখল করা হয়েছে। অথচ এটি রংপুর শহরের প্রাণ।

লালমনিরহাটের মোগলহাটের সিদ্দিক হোসেন বলেন, রত্নাই নদীতে ধরলা নদী থেকে নৌকা চলাচল করত। এখন চলে না।

বেশ কিছু নার্সারি ঘুরে দেখা গেছে দেশীয় গাছের চারার তুলনায় বিদেশি ইউক্যালিপটাসসহ অন্যান্য গাছের আধিক্য। এসব গাছকে বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক বলছেন বিষেজ্ঞরা। তবুও সরকারি স্থাপনায় পুকুর বা নদীর ধার, সড়ক ও ক্ষেত-খামারে  প্রতি বছর লাগানো হচ্ছে বিদেশি এসব ক্ষতিকারক গাছ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা মাসুদ রানার মতে, পূর্ণবয়স্ক একটি ইউক্যালিপটাস গাছ প্রতিদিন ১৮০ লিটার পানি শোষণ করে। বড় হওয়া ছাড়া এ গাছের কোনো উপকারী দিক নেই। এই গাছের কোনো বাগানে সুস্থ মানুষ কিছুক্ষণ থাকলে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। এর কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই ইউক্যালিপটাস বাদ দিয়ে বাসক, বাবলা ও আগরের মতো গাছ রোপণ করতে হবে। ঔষধি গাছগুলো মাটিক্ষয় রোধ করে। এগুলো পশুপাখির আবাসস্থল এবং আদর্শ ছায়াদানকারী। মাটিতে ২৫ শতাংশ পানি, ২৫ শতাংশ বাতাস, ৪৫ শতাংশ খনিজ, পাঁচ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকে। এমন ঔষধি গাছের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা রক্ষা করা যায়।

বন বিভাগ ইউক্লিপটাস ও আকাশমণির মতো গাছগুলোকে ক্ষতির কারণ মনে করছে না। বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ইউক্যালিপটাস গাছের উপকারী দিক আছে। এর থেকে ওষুধ ও বিদ্যুতের খুঁটি তৈরি হয়। লেখালেখির কারণে আমরা এই গাছের চারা উৎপাদন থেকে সরে এসেছি। মানুষকে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগাতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আকাশমণির কাঠ খুবই শক্ত। ঘুণে ধরে না।

রংপুর আবহাওয়া দপ্তরের প্রধান আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন আপস বা ডাউন করছে, তখনই সমস্যা। এপ্রিল মাসে কমপক্ষে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি প্রয়োজন। এবার এপ্রিল মাসে আমাদের এখানে এক মিলিমিটারও বৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে আমরা ভূগর্ভস্থ পানি তুলছি। সেখানে দ্রুত নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। জলাধার বাঁচাতে হবে। একই সঙ্গে ফরেস্ট্রি আমাদের বেশি প্রয়োজন।

লালমনিরহাট সরকারি কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ বলেন, বইপত্রসহ বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, ইউক্যালিপটাসসহ বেশ কিছু গাছ ক্ষতিকারক। ফসলি জমির পাশে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগালে ফসল নষ্ট হয়। বন বিভাগকে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। সরকারি ছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনায় ইউক্যালিপটাস গাছ থাকাটাই অসচেতনামূলক কাজ। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ প্যানেল করে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, ফরেস্টÑএসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর বিধান চন্দ্র দাস প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের ওয়াটার বডি কমে গেছে। এটাই বড় কারণ। আমরা সিভিলাইজেশনের নামে কংক্রিট প্রবেশ করিয়েছি। বিটুমিনের আস্তরণ তাপ রেডিয়েশন করে। সবুজ ঘাসের মাঠ তাপ রেডিয়েশন করে না। যত বেশি পিচ ও কংক্রিটের আস্তরণ পড়বে, ততই তাপ বৃদ্ধি পাবে। জলাশয় রক্ষা করতে হবে। নদী-খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবেই সবুজায়ন হবে। কলকারখানায় চাপ কমাতে গাছ লাগাতে হবে।