প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা!

যেসব শিশুর দৈহিক, মানসিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলো স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় কম হয় বা ভিন্ন হয় তারাই হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশু। ‘শিশু’ শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুটফুটে সুস্থ সবল ছোট্ট একটি মায়াময়ী অবয়ব। একটি সুস্থ সবল শিশু সব মা-বাবারই কাম্য। কিন্তু এমন কিছু শিশু আছে যারা স্বাভাবিক শিশুদের থেকে আলাদা। এদের মধ্যে কেউ কানে শুনতে পারে না, কেউ কথা বলতে পারে না, আবার কেউ কেউ চোখেও দেখতে পায় না, কারও বা বুদ্ধি কম আবার কেউ অনেক বেশি প্রতিভাবান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী। ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়। সিআরসি ও সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। এই দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। জাতীয় শিশু নীতিমালায়ও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশুর অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সমাজ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এমনকি প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম দানকারী মা-বাবাকেও অপয়া মনে করা হয় আমাদের সমাজব্যবস্থায়। যেখানে আমাদের উচিত হচ্ছে, প্রতিবন্ধীদের জন্য সমাজব্যবস্থাকে সহজ করে দেয়া কিন্তু সেখানে আমরা তাদের অবহেলার পাত্র করে রেখেছি। সামাজিক ধ্যান-ধারণার ওপর নির্ভর করে এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ। সমাজ যদি এদের অযোগ্য ও অবাঞ্ছিত মনে করে, এদের উঠে দাঁড়ানোর কোনো স্থান থাকবে না। তাই এসব শিশুদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা আবশ্যক। এছাড়া নিজ পরিবারেও অবহেলার শিকার হন এই প্রতিবন্ধী শিশুরা।

প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১-এও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাসেবা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারপরও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ খুবই কম। এর কারণ হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি অবহেলা এবং প্রতিবন্ধকতার কারণে ঠিকভাবে চলাচল করতে না পারায় স্বাভাবিকভাবেই মা-বাবা সন্তানের সুরক্ষার জন্য বাইরে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে না চাওয়া। এছাড়া সমবয়সীরা প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে মিশতে চায় না, ফলে এদের মানসিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি হয়।

প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন-২০১৩ অনুসারে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। শতকরা ৪৯ ভাগ প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে আনা সম্ভব; যদি প্রারম্ভিক শনাক্তকরণ ও নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা যায়। ইউনিসেফের হেলথ অফিসার মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর জেনেরিকভাবে প্রতিবন্ধিতা দূর করতে তিনটি লক্ষ্যের কথা বলেছেন। প্রথমত, প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল সে াতে সম্পৃক্ত করা। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা। তৃতীয়ত, প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার প্রদান করা।

প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হয়, তা বলতে গেলে অনেক নগণ্য। ফলে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গড়ে উঠে ভিক্ষাবৃত্তি। কাজেই যে ভাতা তাদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে তার পরিমাণ আরও বেশি বাড়ানো দরকার এবং তাদের হাতে পৌঁছানোর জন্য ব্যবস্থা করা উচিত। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সনদ ও শিশু অধিকার সনদ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিবন্ধিত্ব বিষয়ে একটি বৈশ্বিক সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। এর মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য ও তুলনামূলক উপাত্ত পাওয়া যাবে, যা পরিকল্পনা ও সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয় আরও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করবে। সর্বোপরি, পরিবার ও সমাজকে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সহনশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ হতে হবে।

রাফিকা ইসলাম

শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০