Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 10:32 am

প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে বৈষম্য ও অসামঞ্জস্যের বাস্তবতা

প্রতিবন্ধী মানুষ প্রতিদিনই সমাজের বৈষম্য এবং অসামঞ্জস্যের শিকার হন। আমাদের সমাজের মূল্যবোধ, ধারণা এবং নীতিগুলো মাঝেমধ্যে এমনভাবে বিপরীতমুখী যে, তা তাদের জীবনে নানা সংকট সৃষ্টি করে। এই প্রবন্ধে আমরা এমন কিছু বাস্তবতার ওপর আলোকপাত করব, যা একটি বৈষম্যমূলক সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিদিনের জীবনে প্রভাব ফেলে।

সমাজের চাপ, কুসংস্কার এবং ভুল ধারণাগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। অতীতে সমাজ আমাদের প্রাণ খুলে ভালোবাসতে দিত না। এখন যখন আমরা কষ্টে আছি, সমাজ সেই কষ্ট প্রকাশ করার সুযোগও দেয় না। তখন লজ্জা লুকাতাম, এখন কান্না লুকাই। এই দ্বৈত আচরণ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নত হতে দেয়নি এ সমাজ। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য উন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের। অথচ এখন যখন তারা অবনমনের পথে, তখন এ সমাজই তাদের বোঝা হিসেবে দেখছে। এটা সত্যিই একটি বড় অসামঞ্জস্য। শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে তাদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়।
এই সমাজ প্রতিবন্ধী মানুষের সাধারণ হতে শিখিয়েছে। অথচ এখন যারা সমাজে অসাধারণ বা অনন্যা, তারা সমাজে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। সমাজের এই দ্বৈত মানদণ্ড বাস্তবিকই বিভ্রান্তিকর এবং কষ্টদায়ক। এমনকি সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিগুলোর দ্বৈত মানদণ্ড তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
প্রতিবন্ধী মানুষের বিপদে স্রষ্টার আশ্রয় প্রার্থনা করতে শিখিয়েছে এই সমাজ। অথচ এখন সমাজই বলে স্রষ্টা বলতে কিছু নেই। এই বৈপরীত্য বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি করে, যা মানুষের মানসিক এবং আধ্যাত্মিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংকটের কারণে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।
প্রতিবন্ধী মানুষের শিখিয়েছে, একবার না পারিলে দেখ শতবার। অথচ যখন তারা প্রথমবার ব্যর্থ হয়, তখন সমাজই তাদের সবচেয়ে বেশি ধিক্কার দেয়। এই দ্বৈত মানদণ্ড মানবিক মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদের সাহসকে দুর্বল করে দেয়। সবুরে মেওয়া ফলে এই উপদেশ সমাজ প্রতিবন্ধী মানুষদের দিয়েছে। অথচ এখন সমাজই বলছে, সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। এই বৈপরীত্যের কারণে মানুষ ধৈর্য ধারণ করতে এবং সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা অনুভব করে।


আমাদের সমাজ বৈষম্য এবং দ্বৈত মানদণ্ডে ভরা। এই সমাজের ধারণাগুলো মাঝেমধ্যে এমন বিপরীতমুখী যে, তা প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনে অসংখ্য সংকট সৃষ্টি করে। একদিকে তাদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা হয়, অন্যদিকে কষ্ট প্রকাশ করার সুযোগও দেয়া হয় না। উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়, অথচ অবনমনের পথে তাদের বোঝা হিসেবে দেখানো হয়। সমাজের এই দ্বৈত আচরণগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। তাই সমাজের এ অসামঞ্জস্য এবং বৈষম্য দূর করতে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায় এবং সমতার পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের প্রকৃত সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারে এবং উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
সমাজের এই দ্বৈত আচরণ এবং বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য শিক্ষিত হওয়া এবং সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এর মাধ্যমে একটি ন্যায়পরায়ণ এবং সহানুভূতিশীল সমাজ গঠন সম্ভব, যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষ নিজেদের সুরক্ষিত এবং সমান মনে করতে পারেন।

উজ্জ্বল ভট্টাচার্য্য ,

ব্যাংকার ও কলাম লেখক,
সতীশ সরকার রোড,
গেন্ডারিয়া, ঢাকা