Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 9:46 am

‘প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সুরক্ষা ও পরিকল্পিত লক্ষ্য অর্জনে কাজ করেন অর্থ কর্মকর্তা’

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন।পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার শাশা ডেনিমস লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. সারোয়ার হোসেন এফসিএ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস

মো. সারোয়ার হোসেন এফসিএ, শাশা ডেনিমস লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও)। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সি সম্পন্ন করেন। তিনি দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) একজন ফেলো

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।

মো. সারোয়ার হোসেন: রহমান রহমান হক চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সি ফার্ম থেকে আর্টিকেলশিপ শেষে একই প্রতিষ্ঠানে ২০১১ সালে অডিট সুপারভাইজার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। এরপর ২০১২ সালে এম অ্যান্ড জে গ্রুপে হেড অব ইন্টারনাল অডিট হিসেবে যোগ দিই। পরবর্তী সময়ে ওই প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর ২০১৫ সালে শাশা ডেনিমসে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিই।

 শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে ফাইন্যান্সকে কেন বেছে নিলেন?

সারোয়ার হোসেন: ফাইন্যান্স পেশায় ক্যারিয়ার গড়বো এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করি। এরপর আমার বড় ভাই (তিনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট) বাণিজ্য বিভাগে পড়ালেখার পরামর্শ দেন। তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। পরে বড় ভাই ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সিতে ভর্তির অনুপ্রেরণা পাই। এর মর্যাদা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে পেরে ফাইন্যান্স পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ তৈরি হয়।

 শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে একজন ফাইন্যান্স কর্মকর্তার গুরুত্ব ও ভ‚মিকা সম্পর্কে জানতে চাই।

সারোয়ার হোসেন: প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ফাইন্যান্স কর্মকর্তা। যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হলে আর্থিক পরিকল্পনা দরকার। একজন দক্ষ ফাইন্যান্স কর্মকর্তাকে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সুরক্ষা ও দায় পর্যবেক্ষণসহ পরিকল্পিত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেন ফাইন্যান্স কর্মকর্তা। সব প্রতিষ্ঠানেই একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক থাকে এবং সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হয়। এক্ষেত্রে একজন ফাইন্যান্স কর্মকর্তার বেশ ভূমিকা রয়েছে। কারণ ফাইন্যান্স বিভাগ হলো প্রতিষ্ঠানের হৃৎপিণ্ড। প্রতিষ্ঠানের ওয়েলথ ম্যাক্সিমাইজেশন যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, তাহলে এর পেছনের কাঠামো হলো ফাইন্যান্স। অপারশেন ও বিজনেস যদি ফাইন্যান্সের স্ট্র্যাটেজিক ফ্রেমের মধ্যে না হয়, তবে তা কখনোই টেকসই বলা যাবে না। কেন ব্যবসা পরিচালনা করবেন, কীভাবে পরিচালনা করবেন, কতটুকু ব্যবসা আপনার প্রতিষ্ঠানের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে, তা ফাইন্যান্সই বলে দেবে।

শেয়ার বিজ: ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) প্রতিষ্ঠানের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?

সারোয়ার হোসেন: এফআরএ অনেক দিনের আলোচিত একটি বিষয়। আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনার জন্য, রিপোর্টিংয়ের দায়বদ্ধতার প্রসার বাড়াতে আইনটির প্রয়োজন ছিল। এটা অনেক ভালো একটা উদ্যোগ। এর মাধ্যমে অডিটররা জবাবদিহির আওতায় আসবে। এখন আইনের মাধ্যমে একটা কাউন্সিল গঠন করা হচ্ছে। তারাই বিষয়টি দেখভাল করবেন। আইনের সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের করনীতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সারোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের করনীতি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানানসই, তবে যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক চিত্র ধীরে ধীরে উন্নতির গ্রাফ স্পর্শ করে চলেছে। সব গ্রোথ ইনডেক্স ইতিবাচক সংকেত দিচ্ছে। গত চার বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছয় থেকে সাতে এসে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় দেশের উন্নয়নের ধারার সঙ্গে করনীতির সামান্য অমিল রয়ে গেছে। ব্যবসাবান্ধব করনীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে যেমন সঞ্চালিত করবে, তেমনি সরকারের প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণকে নিশ্চিত করবে। তবে কর ব্যবস্থাপনায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমরা যতই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান তুলি না কেন, কর ব্যবস্থায় এখনও সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আছি। আমাদের কর ব্যবস্থাপনার প্রধান তিনটি ধারা ইনকাম ট্যাক্স, ভ্যাট ও কাস্টমসকে অনলাইনের মাধ্যমে এক সুতায় গেঁথে ফেলতে পারিনি। তবে সরকার যেমন নতুন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ও নিচ্ছে, তাতে শিগগিরই আমরা সুন্দরভাবে পরিচালিত করসেবা পেতে যাচ্ছি। কর ব্যবস্থাপনায় উজ্জ্বল একটা সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।

শেয়ার বিজ: বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি সিএ ফার্মের সহযোগিতা নেওয়ার প্রবণতা বেশি কেন?

সারোয়ার হোসেন: বিদেশি সিএ ফার্মের সহযোগিতা নেওয়ার অন্যতম একটা কারণ গ্রুপ পয়েন্ট অব ভিউ। আন্তর্জাতিকভাবে যারা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট করছে তাদেরই একটা সদস্য ফার্ম হয়তো বাংলাদেশে আছে। বহুজাতিক কোম্পানির মাদার কোম্পানি যে অডিট ফার্মের মাধ্যমে অডিট করছে, এদেশেও যদি ওই অডিট ফার্ম থাকে, তবে তার মাধ্যমে অডিট করাতে চায় বা করে। অডিটের ক্ষেত্রে প্ল্যানিং ও রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর এ রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের টুল সবার সমান থাকে না। একটি সিএ ফার্ম কতটুকু দক্ষতার সঙ্গে রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করতে পারবে, অডিট প্ল্যান করতে পারবে, বা সম্পাদন করতে পারবে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর কোনোক্রমে একটা দেশের প্রতিষ্ঠানের অডিটে ভুল হয়ে গেলে সম্পূর্ণ গ্রুপের যে অডিট রিপোর্ট সেটি ভুল হয়ে যায়। এজন্য তারা রিস্ক নিতে চায় না। এ কারণে তারা চায় তাদের অডিট বিদেশি সিএ ফার্ম করুক।

শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে একজন ফাইন্যান্স কর্মকর্তার জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?

সারোয়ার হোসেন: প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্টের থার্ড আই সিএফও। তিনি প্রতিষ্ঠানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার চ্যালেঞ্জও তুলনামূলক বেশি। হিসাবের স্বচ্ছতা স্টেকহোল্ডারদের কাছে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া অন্যতম একটা চ্যালেঞ্জ। সততা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি সৎ, দক্ষ ও অনুগত ফাইন্যান্স টিম গঠন করাও কম চ্যালেঞ্জের নয়।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে ফাইন্যান্স কর্মকর্তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সারোয়ার হোসেন: বেশ চ্যালেঞ্জিং একটা পেশা। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অনেক ক্ষেত্রে ফাইন্যান্স পেশাজীবীর সিদ্ধান্ত ও রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ফাইন্যান্স টিমের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।

 শেয়ার বিজ: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?

সারোয়ার হোসেন: ফাইন্যান্স পেশায় যারা ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদেরকে স্বাগত জানাই। দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে সৎ, পরিশ্রমী ও কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকলে সফল ফাইন্যান্স পেশাজীবী হিসেবে নিজেকে গড়া সম্ভব।