মো. আলমগীর হোসেন: শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারাই আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় তারাই নেতৃত্ব দেবে। জ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে সবার জন্য কল্যাণকর নতুন বিশ্ব। তাই শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষভাবে যতœ নেয়া উচিত। তারা যেন সৃজনশীল, মননশীল ও মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। বর্তমানে বিশ্বে মোট শিশুর সংখ্যা প্রায় ২২০ কোটি। এই শিশুদের অর্ধেকের বেশি কভিড মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৭০ লাখ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার হয়েছে। শিশুশ্রমে জড়িত হয়েছে এক কোটি ৬০ লাখ শিশু। কভিড-১৯ মহামারি ছাড়াও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময়ে শিশুরা যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের শিকার হয়ে তাদের অধিকার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশে শিশুদের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিশুদের জন্য তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন শিশুরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দিবে। দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আউয়ুব খান জোর করেই দেশের ক্ষমতা দখল করে শেখ মুজিবসহ বহু নেতাকর্মীকে জেলে আটকে রাখেন। পাঁচ বছরের জন্য পুরো দেশের রাজনীতি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে জাতির পিতা কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘এই পাঁচ বছর তোমরা শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে কাজ করো। নিজেদের সচল রাখো।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৬৩ সালে ঢাকার প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে কচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত শিশু আনন্দমেলায় এসে বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’ শিশুদের সান্নিধ্যে জাতির পিতার এই অনুভূতি থেকে উপলব্ধি করা যায় শিশুদের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার গভীরতা। সরকারি ও দলীয় কাজে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্ন স্থান সফরে যেতেন, তখন চলার পথে কোনো শিশু দেখলে গাড়ি থামিয়ে সেসব শিশুর সঙ্গে গল্প করতেন ও খোঁজখবর নিতেন। দুস্থ ও অসহায় শিশুদের পরম মমতায় তিনি কাছে টেনে নিতেন। কখনও কখনও নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিজের বাড়িতে বা অফিসে নিয়ে যেতেন। কাপড় ও খেলনাসহ বিভিন্ন উপহার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেন।
৬৯ বছর আগে ১৯৫২ সালে চীনের রাজধানী পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেই শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। শিশুদের উন্নয়নে চীন সরকারের গৃহীত কার্যক্রম ও সে দেশের শিশুদের উন্নয়ন কাছ থেকে দেখেছেন। জাতির পিতার সেই ভ্রমণ ভাবনার মধ্যেও ছিল তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলা। দেশের শিশুদের কীভাবে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেসব ভাবনাও তিনি সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইয়ে। তিনি স্কুল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ‘ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন। তার সঙ্গে এক ঘণ্টা আলাপ হলো। তিনি আমাকে বললেন, বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষার প্রবর্তন করেছি। প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হয়। সরকার তাদের যাবতীয় খরচ বহন করে।’ (‘আমার দেখা নয়া চীন’, পৃষ্ঠা-৬০)। চীনের নতুন ভবন, স্কুল নির্মাণ ও স্কুলশিশুদের দেখে জাতির পিতা তাঁর ভ্রমণকথায় লিখেছেন, “…শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখে ফিরে এলাম। খাওয়া-পরা পেয়ে নয়া চীনের ছেলেমেয়েদের চেহারা খুলে গেছে। মুখে তাদের হাসি, বুকে তাদের বল, ভবিষ্যতের চিন্তা নেই। মনের আনন্দে তারা খেলছে। (‘আমার দেখা নয়া চীন’, পৃষ্ঠা-৬০)।
দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা শিক্ষার উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন দেশের শিশুদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সব শিশু যাতে শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য একসঙ্গে লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকরিসহ ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করেন। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। একইসঙ্গে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিধ্বস্ত স্কুলগুলো নতুনভাবে তৈরি ও সংস্কার করেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করে ১৯৮৯ সালে, যার ১৫ বছর আগে জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন।
জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শিশুদের নিরাপদে বেড়ে ওঠা, সুষম বিকাশ ও সুরক্ষার বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন আইন, নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। একসঙ্গে ২৬ হাজার স্কুল এবং এক লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন করছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডজিতে শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা অর্জনে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মায়ের গর্ভাবস্থা থেকে তিন বছর পর্যন্ত মা ও শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালু আছে। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা এবং তাদের শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রদানসহ নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই ও শিক্ষা উপকরণ তুলে দেয়া হচ্ছে। দেশের বিদ্যালয়গুলোয় নতুন আকর্ষণীয় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পৃথক ওয়াশ রুম করা হয়েছে। স্কুলগুলোয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, যা এক দশক আগে ছিল মাত্র ৬১ শতাংশ। এর ফলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে বহুগুণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক যুগ ধরে সরকার পরিচালনাকালে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী বিভিন্ন আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন, যা দেশে শিশুদের উন্নয়ন ও বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, শিশুর প্রারম্ভিক যতœ ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩, শিশু আইন ২০১৩, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, ডিএনএ আইন ২০১৪, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন ২০১৮ ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০২০, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন ২০২১ ও বাল্যবিয়ে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০৩০ প্রণয়ন করেছেন। কন্যাশিশুর শিক্ষার প্রসারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক পিস ট্রি পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৯ সালের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিরো পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তিনি এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শিশুদের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থনীতির সব সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দরকার শিশুদের উন্নয়নে বিনিয়োগ। শিশুদের ওপর বিনিয়োগ করলে তার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দেশ ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিশুর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ ও তা নিশ্চিত করা। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এ শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য যেসব অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা অর্জনে কাজ চলমান রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে একটা উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এই পরিক্রমায় সরকার শিশুদের ওপর কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ করছে। এই লক্ষ্যে সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ৮০ হাজার কোটি টাকার শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন করছে। এই শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার আগামী প্রজš§কে মেধাবী ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশুর উন্নয়ন, সুরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসহ শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশু বিকাশ কেন্দ্র, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র, শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র, প্রারম্ভিক মেধাবিকাশ কার্যক্রম, আবৃত্তি, সংগীত, চিত্রাঙ্কন, নৃত্যসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এর ফলে আমাদের শিশুরা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করছে। গত দেড় বছরে কভিড-১৯ মহামারির কারণে আমাদের শিশুরা ছিল ঘরবন্দি। তবে এই মহামারিতেও শিশুরা তাদের পড়াশোনা থেকে দূরে ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীটিও কভিড-১৯-এর দুঃসময়ে ঘরে বসে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা কভিড-১৯ মহামারি অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। এখন শিশুদের পদচারণে মুখর শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষার আলোয় বিকশিত হোক তাদের জীবন। সব শিশুর জীবন হোক সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ও নিরাপদ।
পিআইডি নিবন্ধন