বিশেষ প্রতিনিধি: ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও জ্বালানি নির্ভরতার ভুল নীতির কারণে দুই বছর ধরে দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। এতে ঘাটতি বাড়ছে গড় উৎপাদন ব্যয় ও বিদ্যুতের দামে। এ ঘাটতি পূরণে ভর্তুকির পাশাপাশি দুই দফা বাড়ানো হয়েছে বাল্ক (পাইকারি) বিদ্যুতের দাম। তবে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গোনার কারণে উৎপাদন ব্যয় কমছে না। বরং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বাড়ছে।
গত এপ্রিলে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে এ ধরনের একটি বিশ্লেষণ উত্থাপন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দেখা যায়, দেড় বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের বাল্ক বিক্রয়মূল্য ও গড় সরবরাহ ব্যয়ের পার্থক্য বেড়েই চলেছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুতের বাল্ক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট উৎপাদন ব্যয় ও দামের মধ্যে পার্থক্য ছিল মাত্র দেড় টাকা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ৩৫ পয়সা। তবে দুই দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছর ডিসেম্বর পর্যন্ত বাল্ক মূল্যহার ও গড় উৎপাদন ব্যয়ের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৩৩ পয়সা। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও ফার্নেস অয়েলের দাম কমায় আগামী অর্থবছর এ পার্থক্য কিছুটা কমবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৩০ পয়সা। তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ছয় টাকা ৪৯ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে যোগ হবে ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের খরচ। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৬৪ পয়সা। যদিও ওই সময় বাল্ক মূল্যহার ছিল পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি তথা লোকসান ছিল এক টাকা ৫২ পয়সা।
গত (২০২১-২২) অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় আট টাকা ৫৪ পয়সা। তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি আট টাকা ৯৬ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে যোগ হয় ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের খরচ। এছাড়া গত অর্থবছর থেকে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহারের ওপর ছয় শতাংশ উৎসে আয়কর আরোপ করা হয়। এটি কর্তনের পর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ৯ টাকা ৪৪ পয়সা। যদিও ওই সময় বাল্ক মূল্যহার কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ০৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি তথা লোকসান ছিল চার টাকা ৩৫ পয়সা।
এদিকে চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১০ টাকা ৯৩ পয়সা। তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ১১ টাকা ২৭ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে যোগ হবে ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের খরচ। ছয় শতাংশ উৎসে আয়কর কর্তনের পর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ০৩ পয়সা।
যদিও দুই দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৩৩ পয়সা।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ। ডলারের বিনিময় হার এক টাকা বাড়লে পিডিবির লোকসান বাড়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছর জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসে থাকছে। তবে চুক্তির কারণে পুরো ক্যাপাসিটি চার্জই দিতে হচ্ছে। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।
তারা আরও বলেন, গত জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমছে। বর্তমানে এ দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। এছাড়া ফার্নেস অয়েলের দামও অনেক কমেছে। তাই আগামী অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমবে। তবে ডলারের বিনিময় হার দ্রুত বেড়ে গেলে জ্বালানির দাম হ্রাসের সুফল খুব একটা পাওয়া যাবে না।
বিশ্লেষণটিতে চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ের (জুলাই-জুন) ও আগামী অর্থবছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও পিডিবির লোকসানের সম্ভাব্য চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর জুন গিয়ে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমে দাঁড়াবে ১০ টাকা ৫৭ পয়সা। অন্যান্য ব্যয় যোগ করে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়াবে ১১ টাকা ৬৪ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান কিছুটা কমে হবে চার টাকা ৯৪ পয়সা। এদিকে আগামী অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় আরও কিছুটা কমে দাঁড়াবে ১০ টাকা ০৯ পয়সা। অন্যান্য ব্যয় যোগ করে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়াবে ১১ টাকা ১২ পয়সা। যদি বাল্ক মূল্যহার আর নাও বাড়ানো হয় তাহলে প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান কিছুটা কমে হবে চার টাকা ৪২ পয়সা। তবে বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হলে লোকসান আরও কমবে।