প্রত্যয় স্কিম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

মেজবাহ হোসেন : সরকার কি বর্তমানে এতই স্বস্তিকর অবস্থায় আছে, কেন প্রত্যয় স্কিমের মতো বৈষম্যমূলক ও বিতর্কিত একটি পরিপত্র জারি করল? যেখানে সেনা সমর্থিত সরকারগুলো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে সহজে নাড়াতে চায় না বা নাড়ালে তার খেসারত দিতে হয় সেখানে নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার মানদণ্ডে অনেক কাবু ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা কমিয়ে দেয়ার মতো একটি নিন্দনীয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। এটি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়, ঝুঁকি নিয়েই সরকারকে এটি করতে হয়েছে। তাহলে কোটি টাকার প্রশ্ন যে বিরোধী দল যখন পিনপতন নীরবতা, তখন সরকার কার স্বার্থে নিজের নাক কাটার ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষকদের কর্মে ভঙ্গ দিল?

একটি স্বাধীন দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার কি ইচ্ছা করলেই নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে নিজের মনমর্জি পরিপত্র জারি করতে পারে বা বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারে? ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকলে সেটি পারার কথা নয়। এরকম পরিস্থিতিতে উক্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ আর জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় হলে গণশুনানি করে তবেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা। কিন্তু এই প্রত্যয় স্কিম ঘোষণার আগে-পরে কোথাও সেটি করা হয়নি। সরকারি বিধি অনুযায়ী যে কোনো বিষয়ে পরিবর্তন-পরিমার্জন করা প্রয়োজন হলে যে বিষয়টি অবশ্য মান্য সেটি হলো কোনোমতেই বিদ্যমান সুবিধা কমানো যাবে না। যেই দেশের অপ্রতিরোধ্য ‘উন্নয়নের মহাযাত্রা’ কানাডা সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই সেখানে শিক্ষক বেচারাদের দুটি পয়সা বাড়িয়ে না দিয়ে বরং তাদের বৃদ্ধ ও অসহায় সময়ের রিজিকে থাবা কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো ৬৫ বছর বয়সে অবসরে যান; তাহলে তাহলে তাদের স্কিমের হিসাব কেন ৬০ বছর ধরে করা হলো? এমন ভুলের পর আমলাদের সেই ১ হাজার ২০০ নম্বরের পরীক্ষার মাহাত্ম্য কি থাকে? তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমলাদের অধীনে মহাবিদ্যালয় করার কোনো নীলনকশা? 

শিক্ষকদের অধিকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা রক্ষার এই আন্দোলনে অনেক সাংবাদিককেই দুটি প্রশ্ন করতে শোনা যাচ্ছে। এর জবাব শিক্ষকরা দিতে পাচ্ছেন না নাকি দিতে চাচ্ছেন না; সেটি বোধগম্য নয়। যুদ্ধের ময়দানে একবার নেমে গেলে আক্রমণই আত্মরক্ষার একমাত্র পথ, সেখানে সভ্যতা বা সুবিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। খুব সম্ভবত ‘ডু ওর ডাই’ প্রবাদের প্রচলনটা এভাবেই এসেছে। তাই আন্দোলনে নেমে সরকারের এমন হঠকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মিষ্টভাষী হওয়ার অবকাশ নেই। প্রথম প্রশ্নটি হলোÑশিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আন্দোলন কেন? আসলে পৃথিবীতে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামই ত্যাগ বা ক্ষতি স্বীকার ব্যতীত সফল হয়নি আর হয়ও না। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে অগণিত জীবনের বিনিময়ে, সম্ভ্রমের বিনিময়ে, হাজার হাজার মানুষ আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেছে; তাই বলে তো আমরা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করিনি যে এত ত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করে কেন আন্দোলন সংগ্রাম? ছাত্ররাজনীতির নামে প্রতিবছর যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের লাশ ফেলা হয় এমন যুক্তি উপস্থাপন করেও তো শিক্ষাঙ্গনে আমরা সন্ত্রাসী রাজনীতি বন্ধ করতে পারিনি, তাহলে শিক্ষকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে এত প্রশ্ন কেন? এরপরও যদি প্রশ্ন তুলতেই হয় যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের এই ক্ষতির দায় কার তাহলে পরিষ্কার জবাব এই দায় সরকারের। একটি শান্ত ও চলমান প্রক্রিয়ায় কেন উস্কানি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করা হলো, এর পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী? দ্বিতীয়ত, শিক্ষকরা কেন আমলাদের অনুকরণে সুপার গ্রেডের পদ চাইছেন? শিক্ষকতা আর প্রশাসন তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই প্রশ্ন কিন্তু সাংবাদিকরা আমলাদের জিজ্ঞেস করার সাহস বা সুযোগ পায়নি কারণ সুপার গ্রেডের জন্য আমলাদের মাঠে নেমে রোদে পুড়ে আন্দোলন করতে হয়নি। প্রশ্নটা প্রথমে আমলাদের করা দরকার ছিল যে; কেন তাদের সুপার গ্রেড প্রয়োজন, মিলিটারিতে আছে তা-ই? তো মিলিটারি আর প্রশাসন তো সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি প্রতিষ্ঠান! কেন মিলিটারির লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও জেনারেল পদের অনুকরণে সিনিয়র সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব আর মুখ্য সচিব প্রয়োজন? সেনাবাহিনীতে যেখানে জেনারেল ১ জন (৮৬ হাজার স্কেলে) সেখানে প্রশাসনে কেন ২ জন (মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব), আবার সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের ৬টি পদের (খুব সম্ভবত) বিপরীতে সিনিয়র সচিবের ১৭টি পদ কেন (৮২ হাজার স্কেলে)? একটা সময় তো যুগ্ম সচিব দিয়েও মন্ত্রণালয় চালানো হতো। সিনিয়র সচিবদের আদলে পুলিশপ্রধানকেও অনুরূপ মর্যাদা দিলেন। প্রতি বছর বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ আর প্রশাসনকে খোঁজেন না, খোঁজেন বিশ্ববিদ্যালয়কেÑতাহলে শিক্ষকদের পদমর্যাদা নয় কেন? যেখানে অনেক সংসদ সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ২৪০০ সিসির পাজেরো স্পোর্টস মডেলের গাড়ি ব্যবহার করে সেখানে প্রশাসন আর পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য কেন আরও বিলাসবহুল ও ব্যয়বহুল উচ্চ সিসির গাড়ি? এত এত প্রশ্নের সাপেক্ষে কি বড় ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সমান, বাকি ভিসিদের ক্ষেত্রে ও কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সংখ্যক সিনিয়র অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিব তুল্য পদ চাওয়া তো অযৌক্তিক নয়, যেখানে শিক্ষকরা শুধু কিছু সিনিয়র অধ্যাপকের জন্য সিনিয়র সচিব তুল্য পদ চেয়েছে। ২০১৫ সালের পে-স্কেলে আপনি সবার বেতন বৃদ্ধি করলেন সেই কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আপনার কিন্তু আপনি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করলেন ঠিক কী প্রয়োজনে নাগরিক হিসেবে সেই প্রশ্নটি আপনাকে করা যায়। কার ঘাড়ে কয়টি মাথা যে; আপনার সম্মতি ছাড়াই শিক্ষকদের পদ অবনমন করে ৩য় গ্রেডে বেঁধে ফেলে? আবার আপনি বললেন যে সচিবদের মতো বেতন চাইলে সচিবদের মতো পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে। অনুরূপ বিধান আপনি সেনাবাহিনীকে তো বলা হয় না বা হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের জন্য তো চালু করা হয়নি, তাহলে কেন অধ্যাপকদের এই কথা বলেন? আজ পর্যন্ত আপনার সচিবদের নিয়োগে (সহকারী সচিব যারা একসময় সচিব হবে) যোগ্যতা চাওয়া হয় একটি তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে তৃতীয় বা দ্বিতীয় বিভাগ তো নয়ই, এমনকি শুধু প্রথম বিভাগ পেয়েও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নাই। শিক্ষক পদে আবেদনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ন্যূনতম জিপিএ ৪.৫ (৫ স্কেলে যেখানে ৩.৫ কে প্রথম বিভাগ ধরা হয়) এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ৩.৫ (৪ স্কেলে যেখানে ৩.০ কে প্রথম বিভাগ ও ২.৫ কে দ্বিতীয় বিভাগ ধরা হয়) প্রয়োজন হয় আর চাকরি পেতে হলে আরও উচ্চ ফলাফল, স্বর্ণ পদক প্রাপ্তি ও গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশসহ নানা প্রতিযোগিতায় উতরেই তবে শিক্ষক। আপনার সচিবদের চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা অনুরূপ করুন; শিক্ষকরাও তাহলে অনুরূপ পরীক্ষা দিয়েই চাকরিতে প্রবেশ করবে। শিক্ষকদের এখানেই শেষ নয়, এরপরে আইইএলটিএস, জিআরই দিয়ে প্রয়োজনীয় পয়েন্ট অর্জন, বিদেশে একটি পিএইচডি স্কলারশিপ জোগাড় করা, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে কঠোর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে ৪-৫ বছর নিরলস পরিশ্রম করে তবে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া যায় (এটা বেনজীর-আজিজের পিএইচডি নয়)। এই পিএইচডি লাভের পুরো প্রক্রিয়াকে ৫০০০ নম্বরের কোনো পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করলেও অনেক কম হবে, তাই শিক্ষকদের পরীক্ষা দেয়ার কথা বলা আর মায়ের কাছে মামা বাড়ির গল্প করা সমার্থক। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করলে বাংলাদেশে যত পেশাজীবী আছে তাদের মধ্যে কেবল উচ্চ আদালতের বিচারকদের পরেই (বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরেই) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামাজিক সম্মান ও বেতন-ভাতা পাওয়ার কথা।

যেহেতু এত দিন ধরে চলে আসা একটি পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে পেনশন ব্যবস্থায় চাকরিজীবীদের চাঁদা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে (আগে কোনো চাঁদা দিতে হতো না) তার মানে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা কানাডা বা সিঙ্গাপুরের বিপরীত দিকেই এগিয়েছে; ফলে সরকার আর অর্থের সংকুলান করতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত যেসব পদের গ্রেড ইতোপূর্বে বাড়ানো হয়েছিল সেগুলোকে পুনরায় আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে সরকারের খরচ কমানো (পদ বিহীনভাবে যেসব সরকারি কর্মকর্তাদের পদন্নোতি দেয়া হয়েছে (মূলত প্রশাসনে), সিনিয়র সচিব, আইজিপি, ২ জন অতিরিক্ত আইজিপি, যেসব পদ গ্রেড ১ ও ২-এ উন্নীত করা হয়েছে  প্রভৃতি) আর এতেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব না হলে তখন সমন্বিতভাবে সবার থেকেই চাঁদা নেয়া, কিন্তু এই সরকারের আমলে যখন শিক্ষকদের কোনো পদের গ্রেড/মর্যাদা বাড়ানো হয়নি তখন শুধু শিক্ষকদের কাছে বা সিলেক্টিভ কিছু পেশাজীবীর কাছে চাঁদা চাওয়া বৈষম্যমূলক। একদিকে সচিবদের জন্য ৪৩ কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানাবেন, ডিসি-ইউএনওদের জন্য কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি কিনবেন আর অন্যদিকে কারও কারও পেনশনে হাত  দেবেন এমন সিদ্ধান্ত হঠকারী ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০২৫ সাল থেকে সবার জন্য যে পেনশন পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রয়োজন হলে সেটি সবাইকে একসাথে নিয়েই করতে হবে, সবার মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতা রক্ষা করেই করতে হবে; কারও সুবিধা কমিয়ে দিয়ে তাকে আলাদা করা মানে তার প্রতি বৈষম্য ও অবিচার করা। সবশেষে বলতে চাইÑহে রাষ্ট্র লয়ে যাও তোমার ‘জাতি গড়ার মহান কারিগর’ তকমা, ফিরিয়ে দাও আমার সম্মানজনক জীবিকা! 

শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, হাবিপ্রবি

পিএইচডি ফেলো, কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০