কর্ণফুলী দূষণ-দখল রোধে ‘মাস্টার প্ল্যান’

প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই

মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী নদীকে চট্টগ্রামের প্রাণ বলা হলেও সরকারি তালিকায় এখানে অবৈধ দখলদার আছে দুই সহস্রাধিক। আবার চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার ৮৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশের বর্জ্য শোধনাগার প্লান্ট (ইটিপি) নেই। এসব শিল্পকারখানার বর্জ্য কর্ণফুলীতে মিশে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে পানি। কর্ণফুলী দূষণের জন্য বেশি দায়ী স্যুয়ারেজ বর্জ্য। মহানগরীর প্রায় ৬০ লাখ মানুষের স্যুয়ারেজ বর্জ্য কর্ণফুলী নদীর পানি দূষণের প্রধান কারণ। এ নদীকে বাঁচাতেই প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত করা হয়েছিল ‘মাস্টার প্ল্যান’। এ মাস্টার প্ল্যান তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’, ‘স্বল্পমেয়াদি’, ‘মধ্যমেয়াদি’ এবং ‘দীর্ঘমেয়াদি’ অ্যাকশন রেখে সাজানো হয়েছিল ১০ বছরের এ মহাপরিকল্পনা। এতে ৪৫টি মূল কার্যক্রম ও ১৬৭টি সহযোগী কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছিল। নগরের বর্জ্য এবং কলকারখানার দূষিত পানি যাতে নদীতে মিশতে না পারে, সে বিষয়েও আছে নির্দেশনা। তবে এ নির্দেশনা বা মাস্টার প্ল্যান কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পরও কর্ণফুলী নদীর দূষণ-দখল রোধে প্রণীত মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই। মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে জড়িত সংস্থাগুলো জানেই না যে, এ প্ল্যান বাস্তবায়নে তাদের ওপর সরকারি নির্দেশনা রয়েছে!

কর্ণফুলী রক্ষার মাস্টার প্ল্যান তৈরির উদ্যোগটা প্রায় চার বছর আগের। চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’ কর্ণফুলী নদীসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ ও দখলরোধ এবং নাব্য বৃদ্ধির জন্য মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই একনেক সভায় একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৫ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীকে সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালককে (প্রশাসন) সদস্য সচিব করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া চবক চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে দুটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করে মূল কমিটির কাছে দাখিল করে। 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দূষণ ও দখলরোধ এবং নাব্য বৃদ্ধির জন্য প্রণীত মাস্টার প্ল্যানটি গত বছরের ১২ জুলাই অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দেরি না করে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনাও দেন তিনি।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান শেয়ার বিজকে জানান, এ মাস্টার প্ল্যানের এক বছর মেয়াদি ‘ক্র্যাশ’ প্রোগ্রামে রয়েছে নদীর সীমানা নির্ধারণ (তিন থেকে ছয় মাস), নদীতীরের অবৈধ দখল চিহ্নিতকরণ (তিন থেকে ছয় মাস), অবৈধ দখল উচ্ছেদ (জুলাই ২০১৯ থেকে চলমান), অবৈধ দখলমুক্ত নদীর সীমানা সংরক্ষণ (জুলাই ২০১৯ থেকে চলমান), কমিটি গঠন, আইন সংশোধন ও জারি (তিন মাস), নদী খনন (জুলাই ২০১৯ থেকে চলমান) এবং নদীদূষণের কারণ, উৎস এবং প্রকৃতি নির্ধারণের কার্যক্রম (দুই থেকে পাঁচ মাস)।

তথ্যমতে, কর্ণফুলী রক্ষার মাস্টার প্ল্যানে দুই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমে রয়েছে নদীতীরের অবৈধ দখল চিহ্নিতকরণ (ছয় মাস, জানুয়ারি ২০ থেকে জুন ২০), অবৈধ দখলমুক্ত নদীর সীমানা সংরক্ষণ (জুলাই ২০১৯ থেকে চলমান), কমিটি গঠন, আইন সংশোধন ও জারি (ছয় মাস থেকে এক বছর), বিবিধ গবেষণা ও সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা (ছয় মাস থেকে এক বছর), নদীদূষণের উৎস বন্ধ এবং পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ (জানুয়ারি ২০ থেকে চলমান), নাব্যতা নিশ্চিতকরণ (জানুয়ারি ২০২০ থেকে পাঁচ বছর), নদীদূষণের কারণ, উৎস এবং প্রকৃতি নির্ধারণের কার্যক্রম (জানুয়ারি ২০২০ থেকে এক বছর), দূষণ রোধে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন (ছয় মাস-তিন বছর), নদী ও নদী তলদেশের অধিকতর দূষণ প্রতিরোধ (জানুয়ারি ২০২০ থেকে চলমান), নদীদূষণ রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি (জুলাই ২০১৯ থেকে চলমান) এবং হালদা নদীর নাব্য বৃদ্ধি ও দূষণ রোধ (জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২১)।

পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্য মেয়াদি কার্যক্রমে রয়েছেÑঅবৈধ দখল উচ্ছেদ (জানুয়ারি ২০২১ থেকে এক বছর), অবৈধ দখলমুক্ত নদীর সীমানা সংরক্ষণ (জানুয়ারি ২১ থেকে), নদী দূষণের উৎস বন্ধ এবং পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ (জানুয়ারি ২০২০ থেকে), নদীপ্রবাহ নিশ্চিতকরণ (জানুয়ারি ২০২০ থেকে), নদী এবং নদী তলদেশের অধিকতর দূষণ প্রতিরোধ (জানুয়ারি ২০২০ থেকে)।

মাস্টার প্ল্যানের দীর্ঘমেয়াদি (১০ বছর +) কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে অবৈধ দখল ব্যতীত নদীর সীমানা সংরক্ষণ, নদীদূষণের উৎস বন্ধ এবং পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, নাব্য নিশ্চিতকরণ, নদী ও নদী তলদেশের অধিকতর দূষণ প্রতিরোধ, শিল্পকারখানা পুনর্বাসন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার।

অন্যদিকে, এ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নকারীর দায়িত্বে রয়েছে ১৯টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা। এগুলো হলোÑপ্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), বিআইডব্লিউটিএ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক), পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ।

কর্ণফুলী রক্ষার মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নকারী হিসেবে নিজেরা জড়িত কি না, তা জানেন না চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান। 

‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান বলেন, ‘কর্ণফুলী রক্ষার মাস্টার প্ল্যান প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কোনো কাজ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক আছেন। যেভাবে মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে, সেভাবে কর্ণফুলী রক্ষা করা হোক।’

কর্ণফুলী রক্ষার মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই কেনÑপ্রশ্ন করা হলে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি চবকের সচিব ও মুখপাত্র মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘মাস্টার প্ল্যানটি মন্ত্রণালয় করেছে। আমাদের কোনো কপি দেয়নি।’

এদিকে ‘কর্ণফুলী রক্ষার মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়নের কাজ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বলে দাবি করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘প্ল্যানটা চট্টগ্রাম বন্দরই করেছে। বিষয়টা চট্টগ্রামে প্রকাশিত হয়নি। অনুমোদনের পর মাস্টার প্ল্যানের কপি আমার কাছে পাঠানো হয়নি। আমার কী দায়িত্ব আছে, সেটা তো আমাকে বলতে হবে। ওখানে জেলা প্রশাসনের কী কী করতে হবে, তা দেখতে হবে। বন্দরকেই কেন্দ্র করেই মূলত কর্ণফুলী নদী। বন্দরই নিয়ন্ত্রণ করে এ নদী। এ কারণে বন্দরকে তো আমরা বাইপাস করতে পারি না। পাশাপাশি ওখানে বড় বড় অনেক স্থাপনা হয়ে গেছে। মাস্টার প্ল্যানের কপিটা পেলে দেখব, আমাদের কী করণীয় আছে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০