মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান: কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ উপহার বা উপঢৌকন পাঠানোর রীতি আবহমান কালের। দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কে স্বাভাবিকীকরণ বা বিদ্যমান সম্পর্ক অধিকতর সংহতকরণে সরকারপ্রধানদের মধ্যে উপহার বিনিময়ের চলমান রীতি অনুসরণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিষ্টাচারের কথা সুবিদিত। বাঙালির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে কখনও পদ্মার ইলিশ, জামদানি শাড়ি এবং নকশিকাঁথা উপহার হিসেবে প্রেরণের কথা আমরা জানি। এ বছরও আমকূটনীতির আওতায় গত ১৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরন্দ্রে মোদি ও দেশটির রাষ্ট্রপতি রামনাম কোভিন্দের কাছে প্রধানমন্ত্রী আম পাঠিয়েছেন। গত কয়েক বছরে বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহে সুস্বাদু আম উপহার একদিকে যেমন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, পাশাপাশি আম রপ্তানির বাজারকেও করেছে সম্প্রসারিত।
গত বছর মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জš§ শতবার্ষিকী শতবর্ষ পালনের প্রাক্কালে এই আম কূটনীতিতে এসেছিল নতুন মাত্রা। শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নয়, বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে তিনি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের রসালো ফলের রাজা আম। এরূপ উপহারের মধ্যে ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আম। তবে হিমসাগর, ফজলি ও ল্যাংড়া আমও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
উল্লেখ্য, যে কোনো পণ্য তা যত গুণগতমান সম্পন্নই হোক না কেন তার নিজস্বতা এবং উপযোগিতা সম্পর্কে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পরিচিতি না থাকে তবে সে পণ্য বা সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পায় না। ফলে বাজারও সম্প্রসারণ ঘটে না। বাংলাদেশের আম অত্যন্ত সুস্বাদু হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর কোনো পরিচিতি ছিল না। ফলে রপ্তানি অর্ডারও আশাব্যঞ্জক ছিল না। গত বছর কয়েক বছর আমকূটনীতির কারণে আম উপহার দেয়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচার পেয়েছে। তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি আমের রপ্তানি অর্ডার বাড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের আমের ব্র্যান্ডিং হওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি অনেক বেড়েছে বলেও রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম। ১০ বছর আগে ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন নিয়ে উৎপাদনে অবস্থান ছিল দশম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানেও উঠেছিল। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ মাসে বাংলাদেশ থেকে ফলটি রপ্তানির পরমিাণ ছিল মাত্র ৪০ হাজার ডলার হলেও, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রপ্তানি হয়েছে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ডলার। দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপের ১৮টি দেশে আম রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন গত বছর বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। অথচ ২০২১-২২ বছরে আম রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টন, যা বিরাট অর্জন।
বেশ ক’বছর আগেই ক্ষীরশাপাতি আম পেয়েছে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স) পণ্যের স্বীকৃতি। এই তালিকায় হাঁড়িভাঙ্গা আমও আসতে পারে। জিআই পণ্যের অধিকার হচ্ছে ভৌগোলিকভাব এই বিশেষ পণ্যটি প্রাকৃতিকভাবেই একটি দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ক্ষীরশাপাতি আম রপ্তানি বা বিক্রির ক্ষেত্রে একক স্বত্বের অধিকারী বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিকভাবে এই আমের উৎপাদন স্বত্ব বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে তাই পণ্যের ব্র্যান্ডিং গুরুত্বপূর্ণ।
এ বছর চলতি মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে নওগাঁয় আম সংগ্রহ শুরু হয়েছে। প্রশাসনের বেঁধে দেয়া সময়সীমা অনুযায়ী, এই মৌসুমে ২৫ মে গুটি জাতের আম, ৩০ মে থেকে গোপালভোগ, ৫ জুন ক্ষীরশাপাতি বা হিমসাগর, ৮ জুন নাক ফজলি, ১২ জুন ল্যাংড়া ও হাঁড়িভাঙা, ২২ জুন ফজলি, ২৫ জুন আম্র্রপালি জাতের আম সংগ্রহ হচ্ছে। ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনি আম সংগ্রহ করা হবে। আম সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে এবার প্রস্তুতি কী বা আম রপ্তানিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার।
আম রপ্তানিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য উন্নত জাতের আমের অভাব। স্থানীয় আমের জাতগুলোর শেলফ লাইফ কম, অর্থাৎ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া মানসম্মত কৃষি পদ্ধতির চর্চা, আন্তর্জাতিকমানের প্যাকেজিংয়ের অভাব উৎপাদনে উত্তম কৃষিচর্চা অভাব এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে আমের ব্র্যান্ডিং সংকটের কারণে এতদিন আম রপ্তানিতে সুফল আসেনি। বাংলাদেশের আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ইউরোপের দেশগুলোতে। কিন্তু আমাদের রপ্তানি সক্ষমতা থাকলেও এয়ারলাইনসের সমস্যার কারণে আমরা খুব বেশি রপ্তানি করতে পারিনি। এয়ারলাইনসের সমস্যা দূর হলে বর্তমানের চেয়ে বেশি আম রপ্তানি সম্ভব বলে জানিয়েছেন কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক সমিতি।
এখন সারাদেশেই আম চাষ হচ্ছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে একসময় হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের চাষ বেশি হতো। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় ব্যাপকভাবে আম্রপালি আমের চাষ হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর আমের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে আম উৎপাদনকারী জেলার দূরত্ব অনেক। পরিবহন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ নানা কারণে প্রতি বছর তাই উৎপাদিত আমের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। অত্যন্ত আনন্দের খবর এই যে নষ্ট রোধ করে বিদেশে বাড়তি আম রপ্তানরি উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে ডিএই। অধিক আম উৎপাদন হয় এমন জেলার যেসব কৃষকের ৫০ শতকের বেশি কৃষিজমিতে আম বাগান রয়েছে তাদের উপকারভোগী কৃষক হিসেবে বাছাই করা হবে। রপ্তানিমুখী বাজার সংযোগ স্থাপন প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য।
প্রকল্পের আওতায় পাঁচ শতাংশ আমের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আম নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষাসহ বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন বাড়ানো হবে। এতে রপ্তানি বাড়বে দ্বিগুণ। এছাড়া প্যাকেজিং, আম ব্র্যান্ডিং, ওয়াশিংসহ সব ধরনের সুবিধা পাবেন কৃষক। এছাড়া নিরাপদ আমের নিশ্চয়তা দিতে ইতোমধ্যে ৩টি ভ্যাকুয়াম হটি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কাজ চলছে। উৎপাদন থেকে শিপমেন্ট পর্যন্ত আম নিরাপদ রাখতে উত্তম কৃষিচর্চা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট দেয়ার কাজ চলছে। এর ফলে আগামী বছর আম রপ্তানির পরমিাণ অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।
আসন্ন মৌসুম সামনে রেখে এরই মধ্যে আম রপ্তানির রোডম্যাপ করা হয়েছে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এক লাখ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে রপ্তানির উপযোগী আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আম রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সঞ্চারিত হয়। কৃষিপণ্যের রপ্তানি ও বাণিজ্যিকীকরণের ওপর জোর দিয়েছে সরকার।
আমরা আশা করব, আমকূটনীতির মাধ্যমে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে এই সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট মহল আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
পিআইডি নিবন্ধ