প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে হেরেও আলোচনায় পিএম

রতন কুমার দাস: মার্গারেট থ্যাচার ও থেরেসা মে-এর পর ব্রিটেন ফের নারী প্রধানমন্ত্রী পেতে চলেছেন সাবেক এই দুই প্রধানমন্ত্রীর কনজারভেটিভ (টরি) পার্টি থেকে প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসবেন পেনি মরড্যান্ট, এমন গুঞ্জন ওঠে। নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পিএম (প্রাইম মিনিস্টার) ডাকা হচ্ছিল এই বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী পেন মরড্যান্টকে। তবে অগ্রগামী এই প্রার্থী পঞ্চম দফা ভোটে তৃতীয় অবস্থানে থাকায় লড়াই থেকে ছিটকে পড়েছেন। তবু তাকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। কেননা রাজনৈতিক জীবনের প্রথম জেনারেল নির্বাচনেও তিনি হেরে যান, এরপর অব্যাহত থাকে তার জয়ের ধারা।

বরিস জনসনের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও পিএম এগিয়ে ছিলেন। প্রথমজন কনজারভেটিভ পার্টির সংসদ সদস্যদের ভোটে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়জন সদস্যদের পছন্দের শীর্ষে ছিলেন। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছিল, পিএম হতে পারেন ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।

বর্তমানে ঋষি সুনাকের সঙ্গে তালিকায় রয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। লিজ জনসনের প্রিয়ভাজন। তার সম্ভাবনা থাকলেও সেই তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রীই পাবে ব্রিটেন। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন মূলত ব্যাকবেঞ্চারখ্যাত সাধারণ সংসদ সদস্যরা। তাদের কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন ঋষি সুনাক।

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া শেষ। হেরে গেলেও পিএম বা পেনি মরড্যান্টের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের ভূমিকা জানা যাক, যা আলোচিত হচ্ছে ব্রিটেনে। কেননা প্রার্থীদের অতীত ও ব্যক্তিগত জীবন এখন দেশটির প্রধান আলোচনার বিষয়। পিএম ছিলেন নৌসেনা। এরপর জাদুকরের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। পরে নাম লেখান রাজনীতিতে।

পেনি ২০০৩ সালের নভেম্বরে কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হন। এর দুই বছর পর ২০০৫ সালে পোর্টসমাউথ নর্থের জেনারেল নির্বাচনে অংশ নেন। হেরে যান সারাহ ম্যাকক্যার্থির কাছে। পুনরায় নির্বাচিত হন ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে এবং ২০১০ সালের জেনারেল ইলেকশনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন। ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালেও জয়ের ধারা বজায় রাখেন।

পেনি ২০১০ সাল থেকে পোর্টসমাউথ নর্থের সংসদ সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। ডেভিড ক্যামেরুন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আর্মড ফোর্সড মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে জনসন সরকারের বাণিজ্য নীতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

প্রসঙ্গত ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফর করেন পেনি। সফরকালে তিনি কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। এছাড়া ইউকেএইডের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা গ্রহণকারী ও রাখাইনে সহিংসতা শিকার হওয়া রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

১৯৭৩ সালের ৪ মার্চ ডেভনের টরকুয়েতে পেনির জš§। তার পুরো নাম পেনিলোপ মেরি মরড্যান্ট। বাবা জন মরড্যান্ট ছিলেন প্যারাট্র–পার। মা জেনিফার ছিলেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষক। পনের বছর বয়সে মাকে হারান পেনিÑস্তন ক্যানসারে মারা যান তার মা। পেনির দুই ভাই রয়েছেন। যাদের একজন তার যমজ ভাইÑজেমস। ছোট ভাই এডওয়ার্ডÑমায়ের মৃত্যুর পর তার লালনপালন শুরু করেন পেনি। একই বছর বাবার ক্যানসার ধরা পড়ে। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

পেনির পড়ালেখা শুরু হয় হ্যাম্পশায়ারের ওকল্যান্ডস রোমান ক্যাথলিক কম্প্রিহেনসিভ স্কুলে। পরে নাটক নিয়ে পড়ালেখা করেন ভিক্টোরিল্যান্ড থিয়েটার স্কুলে। পড়ালেখার খরচ বহন করার জন্য জনসন অ্যান্ড জনসনের কারখানায় কাজ করতেন। পরে জাদুকর উইল অ্যালিংয়ের সহকারী হন।

১৯৮৯ সালে রোমানিয়ার বিপ্লবের পর সে দেশের হাসপাতাল ও এতিমখানায় চাকরি করার সময় রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন পেনি। পরে দেশে ফিরে রিডিং ইউনিভার্সিটিতে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন, উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণির ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তার আগে পরিবারের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি এবং রিডিং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গ্র্যাজুয়েশনের পর পেনি জনসংযোগ খাতে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের শাসনামলে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির হেড অব ইয়ুথ ছিলেন। এর আগে দুই বছর দলীয় নেতা উইলিয়াম হেগের অধীন পার্টির হেড অব ব্রডকাস্টিং পদে কাজ করেন। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ফ্রেইট ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়শনে (বর্তমানে লজিস্টিকস ইউকে) কমিউনিকেশন্স স্পেশালিস্ট ছিলেন। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের প্রেসিডেন্ট ক্যাম্পেইনের ফরেন প্রেসের প্রধান ছিলেন পেনি। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রয়েল বোরো অব কেনিংস্টন অ্যান্স চেলসির কমিউনিকেশন্স ডিরেক্টর ছিলেন। এই চাকরি ছাড়ার আগে অ্যাংলো-আমেরিকানদের জন্য ‘ভার্চুয়ালকনজারভেটিস’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেন।

পেনি ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মিডিয়া ইন্টেলিজেন্স পার্টনারসের ডিরেক্টর ছিলেন। এর মধ্যে ২০০৪ সালে ফের বুশ ক্যাম্পেইনে কাজ করেন। এছাড়া কমিউনিটি ফান্ডে ও ডায়াবেটিস ইউকের পরিচালক হন।

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাব্যবস্থাকে সমর্থন করা পেনি ব্রেক্সিটের বড় সমর্থক। তিনি ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের ফেলো। ২০১৪ সালে দ্য স্পেক্টেটর ম্যাগাজিন তাকে ‘পার্লামেন্টারিয়ান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দেয়। ক্রিস লুইসের সঙ্গে যৌথভাবে লেখেন ‘গ্রেটার: ব্রিটেন আফটার দ্য স্ট্রম’, বইটি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে।

বরিস জনসনের উত্তরসূরি নির্বাচন করতে গত ১৩, ১৪, ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই যে ভোট দেন টরি পার্টির সদস্যরা তাতে পেনি যথাক্রমে ৬৭, ৮৩, ৮২, ৯২ ও ১০৫ জনের সমর্থন পান। ধারাবাহিকভাবে তার প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকায় আশা করা হচ্ছে, প্রথমবার রাজনৈতিক নির্বাচনে হেরে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, এর পরের বার থেকে প্রধানমন্ত্রীর লড়াইয়েও তিনি সবার ওপরে থাকবেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০