Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 9:01 pm

প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান করলে হুন্ডি প্রতিরোধ সম্ভব

মো. জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস হলো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। মূলত প্রবাসীদের মাধ্যমে অর্জিত আয়ই রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স হলো দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি, উন্নয়নের ভিত্তি, স্বপ্নের সোনালি সোপান ও অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্সের অবদান মোট জিডিপির ১২ শতাংশ এবং বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রবাসীরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে, তা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেক। প্রবাসীদের কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ একটি সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় সরকার বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা অধিক রেমিট্যান্স আহরণের জন্য দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি এবং প্রবাসীদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ রেমিট্যান্সের টাকায় তৈরি হয়েছে ছোট ছোট উদ্যোক্তা এবং শক্তিশালী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি।

স্বাভাবিকভাবে রেমিট্যান্স আহরণের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডি কারবারিরা সারাবিশ্বে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এরা বেশ শক্তিশালী ও সদা সক্রিয়। মুহূর্তের মধ্যে তারা বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতা ও সামর্থ্য রাখে। নির্ধারিত এজেন্টের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজনের ঠিকানায় হুন্ডির টাকা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচার হলে দেশের অর্থনীতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটির এক তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশে হুন্ডিচক্র এতটাই সক্রিয় হয়ে উঠেছে যে, ব্যাংকিং বা অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে অত্যন্ত দ্রুত এবং কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই তারা গ্রাহকের ঠিকানায় টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরে খরচ কম। এ কারণেই পাচারকারীরা হুন্ডিকেই পছন্দ করে বেশি। বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির বিপরীতে অর্থ পাচার হয়ে বিদেশে যায়, আর রেমিট্যান্সের মাধ্যমে হুন্ডির অর্থ আসে। বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকায় প্রবাসী শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। মূলত যারা অবৈধভাবে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছে, কিংবা যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ, তারাই বাধ্য হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপ বলছে, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠায় তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে আসে ৩০ শতাংশ এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে।

প্রবাসীদের স্বজনেরা আসলে হুন্ডি কী, তা-ই বোঝেন না। একইভাবে অশিক্ষিত ও অদক্ষ প্রবাসীদের হুন্ডি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তারা যেকোনো মাধ্যমে স্বজনদের কাছে দ্রুত টাকা পাঠাতে পারলেই বেজায় খুশি। অশিক্ষিত প্রবাসীরা ব্যাংকে গিয়ে একদিকে ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করতে পারে না, আবার অনেকে লেখার ভয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো ঝামেলা ও সময়সাপেক্ষ মনে করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে। হুন্ডি দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা তারা বোঝার চেষ্টাও করে না। তবে তাদের বুঝিয়ে বললে তারা এটার জন্য অনুতপ্ত হয়। এজন্য তাদের প্রবাস গমনের আগে হুন্ডি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া দরকার।

ভুক্তভোগী প্রবাসীরা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে হলে আয়ের বৈধ সনদ নিতে হয়। একইভাবে পাঠানো অর্থের সুবিধাভোগীদের পুরো তথ্য দিতে হয়। এর ফলে অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলকে হয়রানি মনে করে বিকাশসহ হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী। যেসব প্রবাসী নানা কারণে বৈধতা পায়নি, তারা টাকা আয় করলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে পারে না। ফলে অধিকাংশ প্রবাসী বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে অবৈধ পন্থা বেছে নিচ্ছে। আবার হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠালে ব্যাংকের চেয়ে ভালো দাম পাওয়া যায়, পাশাপাশি কোনো চার্জ দিতে হয় না। এখানেই শেষ নয়, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ব্যাংক থেকে তুলতে গিয়ে আরেক ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় বলে তাদের অভিযোগ। তাদের মতে, সময়ও বেশি লাগে। ব্যাংকের রেট কম হওয়ায় এবং চার্জ কাটার কারণে টাকার পরিমাণ কমে যায়। অথচ হুন্ডিতে পাঠালে একদিকে সময় বাঁচে, টাকাও পাওয়া যায় তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী শ্রমিকের সরাসরি বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। এসব কারণে বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ প্রবাসীই অবৈধ পথ ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে সহজ ও স্বল্প সময়ে নিকটজনের কাছে অর্থ পৌঁছে যাচ্ছে।

এসব কারণে দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বৈধ চ্যানেলের ঝামেলা এড়াতে অবৈধ চ্যানেল বেছে নিচ্ছেন প্রবাসীরা। বিদেশে অবস্থিত ব্যাংকগুলোর এক্সচেঞ্জ হাউসের তথ্যমতে, মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে অতিরিক্ত কড়াকড়ির কারণে রেমিট্যান্স পাঠানো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগে যেখানে খুব সহজেই রেমিট্যান্স পাঠানো যেত, এখন সেখানে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হয়। এ কারণে একদিকে অব্যাহতভাবে কমছে প্রবাসী আয়, অন্যদিকে বাড়ছে হুন্ডির প্রবাহ। এ প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের একটি এক্সচেঞ্জ হাউসের এক কর্মকর্তার তথ্যমতে, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে সংশ্লিষ্ট দেশে কিছু নিয়ম মানতে হয়। প্রবাসীদের অনেকেই সেই নিয়ম মানতে নারাজ। তারা দ্রুত এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়া টাকা পাঠাকে ইচ্ছুক। এ কারণে বিকাশসহ হুন্ডি চক্রের আধিপত্য বাড়ায় প্রবাসীদের একটা বড় অংশ ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউসেই আসে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনি¤œ রেমিট্যান্স এসেছে গত অর্থবছরে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমেছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে ৭৩০ কোটি ৭১ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। সৌদি আরব থেকে এসেছে ২২৬ কোটি ৭২ লাখ ডলার। দেশটি থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ২৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৪২ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। গত অর্থবছরে তা ১৬৮ কোটি ৮৮ লাখ ডলারে নেমেছে। অন্যদিকে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ১৭ শতাংশ। কাতার ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ থেকে কমেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় প্রত্যেক প্রবাসীর মাসিক আয়ের একটা সনদ থাকে, যার কারণে প্রবাসীদের আয়ের ওপর নির্ভর করেই দেশে টাকা পাঠাতে হয়। সনদের বাইরে অতিরিক্ত কাজ করে অর্জিত টাকা বৈধভাবে রেমিট্যান্স আকারে প্রবাসীরা পাঠাতে পারে না। কেননা অতিরিক্ত আয়ের সঠিক তথ্য দিতে না পারলে আইনি জটিলতায় পড়তে হয়। আয়ের যথাযথ উৎস না থাকায় সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের ১৫ হাজার কুয়েত প্রবাসীকে সেদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ কারণে ভুক্তভোগী অনেক প্রবাসী আয়ের সনদ থেকে মাসিক আয় কয়েকগুণ বেশি থাকায় এসব ব্যবস্থা নেয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাদের দাবি, কষ্টার্জিত আয় যেন অবৈধপথে পাঠাতে না হয়, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে সরকার যেন সেসব সমস্যার সমাধান করে।

আবার অনেকে বৈধ ভিসায় প্রবাসে গেলেও আকামা বা ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে না পারায় অবৈধ হয়ে যান। আবার যারা দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে কাজ করেন, তাদের কোথাও না কোথাও কাজ করে উপার্জিত টাকা বৈধভাবে দেশে পাঠানোর সুযোগ না থাকায় তারা ঝুঁকছেন হুন্ডির দিকে। আবার অনেকে বৈধভাবে কাজ করে আয় করলেও তাদের আবাসস্থল থেকে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউস শত শত মাইল দূরে অবস্থান করায় তারা ইচ্ছা থাকলেও বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন না। তখন বাধ্য হয়ে তাদের নিকটস্থ হুন্ডির ওপর নির্ভর করতে হয়।

বাংলাদেশ থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে বিদেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী যাওয়ার ফলে শুধু প্রবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু শ্রম অনুযায়ী রেমিট্যান্স বাড়ছে না। দেখা গেছে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন প্রবাসী কর্মীরা ভালো বেতনের চাকরিতে নিয়োগ পান এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অধিকতর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অদক্ষ কর্মীরা যে পরিমাণ অর্থ পাঠান তা দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও বাংলাদেশের কর্মীদের মান অনেক নিচে। দেখা গেছে, অদক্ষ প্রবাসীরা অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হন এবং তারা কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করলেও বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন না। এ কারণে তারা রেমিট্যান্স প্রেরণে হুন্ডিকেই বেছে নয়।

প্রবাসীরা বলছেন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের মতো দেশে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠাতে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস আছে এবং তারা এসব অ্যাপসের মাধ্যমে নিমিষেই ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের দেশে বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবাসীরা এ ধরনের অ্যাপস না থাকায় অনেকে ব্যাংকের মাধ্যেমে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন। সম্প্রতি প্রবাসীদের দাবির মুখে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ মওকুফ করা হয়েছে, এটা খুবই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। প্রবাসীরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের অবৈধ শ্রমিকদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বৈধকরণ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি রপ্তানিতে গুরুত্বারোপ এবং সহজে অ্যাপসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা করলে হুন্ডির প্রবাহ কমে রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com