রোহান রাজিব: সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ কমছেই। শুধু তা-ই নয়, আগে কিনে রাখা সঞ্চয়পত্র ভেঙে চলছেন একশ্রেণির মানুষ। এক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সঞ্চয় ভাঙানোর প্রবণতা বেশি।
সাধারণত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সরকারের তিন বন্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা যে পরিমাণ বন্ড কিনেছেন, ভাঙিয়েছেন তার চেয়ে ১৮২ কোটি টাকা বেশি। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রবাসী তিন বন্ড বিক্রি হয়েছে ৭৮২ কোটি ২৭ লাখ টাকার। এ সময়ে তারা ভাঙিয়েছেন এক হাজার ৯৬২ কোটি ৬১ লাখ টাকার। এতে বোঝা যাচ্ছে, এ খাতে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া তো দূরে থাক, নিট কমেছে এক হাজার ১৮০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মুদ্রার মূল্যমানে বড় পরিবর্তন এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে সুদহার বেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম মার্কিন বন্ডের সুদহার বাড়ানো। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ানো হয়নি। ফলে বন্ড থেকে যে সুদ পাওয়া যাচ্ছে সেটি চলে গেছে মূল্যস্ফীতির নিচে। তাই বাংলাদেশি প্রবাসীরা বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি তারা এসব বন্ড ভেঙে যেসব দেশে সুদহার বেশি সেখানে বিনিয়োগ করছেন। ফলে এ খাতে সঞ্চয় কমেছে।
বর্তমানে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্টে তিন ধরনের প্রবাসী বন্ড রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের আগে প্রবাসীরা এসব বন্ডে যেকোনো পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারতেন। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর এক নির্দেশনার মাধ্যমে তিন ধরনের বন্ড মিলে সমন্বিত বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা হয় এক কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যে গত এপ্রিলে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেয়া হয়েছে। ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বসীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে বিনিয়োগের বিপরীতে সুদহার কমানো হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চাপের সময়ে সুদহারে পরিবর্তন আনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদরা।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিক্রি হয়েছে ৪৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার। এ সময় ভাঙানো হয়েছে এক হাজার ৪২৮ কোটি ১৬ লাখ টাকার। ফলে নিট বিক্রি কমেছে ৯৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকার। এছাড়া ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের নিট বিক্রিও কমেছে। আট মাসে নিট বিক্রি কমেছে ২৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকার। এ সময়ে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা জমা করেছেন। আর ভাঙিয়েছেন ৪৫৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার। ফলে নিট বিক্রি কমেছে।
অপরদিকে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড নিট বিক্রি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এ বন্ডে বিনিয়োগ হয়েছে ৭৮ কোটি ১৫ লাখ টাকার। এ সময়ে ভাঙানো হয় ৭৭ কোটি ১৭ লাখ টাকার। অর্থাৎ নিট বিক্রি বেড়েছে ৯৮ লাখ টাকার।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আগে মেয়াদ শেষ হলে বন্ডগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন হতো। এখন নবায়নের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসে যেতে হয়। তাই নবায়নের হার কমেছে। অপরদিকে নগদায়ন বা বন্ড ভাঙানোর প্রবণতা বেড়েছে। আবার যাদের বেশি বিনিয়োগ ছিল, তারাও বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলছেন। এসব বন্ডে বিনিয়োগের বড় অংশ প্রবাসী ব্যবসায়ীদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। এসব বন্ড থেকে যে সুদ পাওয়া যাচ্ছে সেটি চলে গেছে মূল্যস্ফীতির নিচে। যারা বিনিয়োগ করবে তারা দেখছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। ডলারে বিনিয়োগ করে তারা রিটার্ন পাচ্ছে টাকায়। কমে গেছে টাকার মূল্যমান। রেমিট্যান্স কমে যাওয়াও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
সঞ্চয়পত্রেও বিনিয়োগ কমেই চলেছে। সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্ণ হলে নতুনভাবে বিনিয়োগের অভ্যাসের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৫৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার বিনিয়োগ এসেছে সঞ্চয়পত্রে।
অন্যদিকে ৫৯ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। সুতরাং আট মাসে তিন হাজার ৫১০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ১০৫ কোটি টাকার। তবে মূলধন পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকার। সুতরাং বিক্রির চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ নিট বিক্রি বা ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৪০ কোটি টাকায়। তথ্য বলছে গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকার।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে এবার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে সরকার। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার। একই সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না নিয়ে উল্টো আগের নেয়া ঋণের প্রায় ৪ হাজার ৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়।
প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার। এটি গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
গত অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে তুলনামূলক কম ঋণ পেয়েছিল সরকার। পুরো অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ আসে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, তিনটি কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রথম কারণ হলো এখন মানুষের হাতে টাকা কম। ফলে সংসার চালাতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন। দ্বিতীয়টি হলো- ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে আয়কর রিটার্নের সিøপ জমা করতে হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অনেকে এ ঝামেলায় যেতে চান না। তৃতীয়ত- বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে যাদের আগে থেকে বেশি বিনিয়োগ ছিল, তারা মেয়াদপূর্তিতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এছাড়া প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা ও এনআইডি শর্তের কারণে সেখানে কম বিনিয়োগ হয়েছে। যদিও সম্প্রতি প্রবাসী বন্ডের বিনিয়োগ সীমা ও এনআইডি শর্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।