নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদেশগামী কর্মীদের সহায়তা দেওয়া, প্রবাসীদের কল্যাণে কার্যক্রম পরিচালনা এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের কল্যাণার্থে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রকল্প গ্রহণ এ বোর্ডের অন্যতম কাজ। এছাড়া নারী অভিবাসী কর্মীদের কল্যাণে বোর্ডের ওপর থাকছে বিশেষ দায়িত্ব। বিদেশে কর্মরত কোনো নারী অভিবাসী বিপদগ্রস্ত হলে তাকে উদ্ধার, আইনগত সহায়তা দেওয়া ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে বোর্ড পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
প্রবাসীদের জন্য কল্যাণ বোর্ড গঠনে ‘প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৭’ শীর্ষক আইনের একটি খসড়া গতকাল সোমবার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এ মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া গতকাল মন্ত্রিসভায় ‘বস্ত্র আইন ২০১৭’-এর খসড়া, ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন ২০১৭’-এর খসড়া, ‘বালাইনাশক আইন ২০১৭’-এর খসড়া, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ এবং উদ্ভাবনীমূলক কাজের জন্য অনুদান প্রদান সম্পর্কিত (সংশোধন) নীতিমালা-২০১৬’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন এবং ভারতের সঙ্গে দুটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ২৫ মার্চ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার একটি প্রস্তাব অনুমোদন এবং শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শততম টেস্টে জয়লাভ করায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছে মন্ত্রিসভা।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিতের জন্য ১৯৯০ সালের জাতিসংঘের একটি কনভেনশন আছে। আমরা এটার স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এ কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে আমাদের একটি আইন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। সেজন্য এ নতুন আইনটির প্রস্তাব করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বিধিমালা, ২০০২ দিয়ে কাজটি করে আসছি। সেটাকে একটু গুছিয়ে আইনের আকারে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড নামে একটি বোর্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অনেকগুলো কাজ রয়েছে।’
খসড়া আইনে বোর্ডকে ২১টি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘বিদেশাগামী কর্মীদের জন্য প্রাক-বহির্গমন ব্রিফিং সেন্টার স্থাপন, পরিচালনা ও ব্রিফিং প্রদান; বিদেশগামী কর্মীদের সহায়তা দেওয়া; তাদের নির্ভরশীলদের কল্যাণার্থে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ; প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা; প্রবাসীদের কেউ মারা গেলে মৃতদেহ আনা বা ক্ষেত্র অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করা; এজন্য আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া বোর্ডের কাজ। অসুস্থ, আহত বা শরীরিকভাবে অক্ষম প্রবাসীদের দেশে আনা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও বোর্ডের কাজ।’
প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পরিষদ থাকবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব চেয়ারম্যান ও প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কল্যাণ বোর্ডের প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক।’
বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠায় নিবন্ধনের বিধান রেখে বস্ত্র আইন: দেশে যে কোনো ধরনের বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠায় নিবন্ধনের বিধান রেখে ‘বস্ত্র আইন ২০১৭’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বস্ত্র শিল্পগুলোকে ভালোমতো দেখভালের জন্য এই আইনটি হচ্ছে। বস্ত্র শিল্পগুলোকে এই আইনের অধীন বিধির আলোকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধন নিতে হবে। তবে যেসব বস্ত্রশিল্প বর্তমানে চলছে সেগুলোকে নতুন করে নিবন্ধন নিতে হবে না। নতুন আইনের মাধ্যমে বস্ত্রশিল্পের সুপারভাইজারি ও মনিটরিং প্রক্রিয়া জোরদার করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া নতুন আইনে সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ ও বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় হস্তান্তরিত বা বিক্রীত বস্ত্রমিল সম্পাদিত চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করলে সরকার ওগুলো আবার নিয়ে যেতে পারবে। নতুন আইনে বলা হয়েছে (তিন নম্বর ধারায়), সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় হস্তান্তরিত বা বিক্রীত বস্ত্রমিলগুলো সম্পাদিত চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করলে সরকার তা পুনরায় গ্রহণ করতে পারবে। অর্থাৎ যেগুলো হ্যান্ডওভার হয়ে গেছে, তারা যদি শর্ত লঙ্ঘন করে তাহলে সরকার তা টেক ব্যাক করতে পারবে। এ বিধানটা আনা হয়েছে। সরকার মিলগুলো ফিরিয়ে নিতে পারবে।’
ভারতের সঙ্গে সম্পাদিতব্য দুটি চুক্তির খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন: গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিতব্য দুটি চুক্তির খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে: ভারতের উদ্যোগে ‘সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। এ লক্ষ্যে ‘এগ্রিমেন্ট বিটুইন দ্য গভর্নমেন্ট অব রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল রিপাবলিক অব বাংলাদেশ কনসার্নিং টু অরবিট ফ্রিকোয়েন্সি কো-অর্ডিনেশন অব সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট প্রোপোজড অ্যাট ৪৮ ডিগ্রি ইস্ট’ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘সার্কসহ আশপাশের কয়েকটি দেশ মিলে সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট নামে একটা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে, সেটা ভারতের উদ্যোগে করা হবে। ইতোমধ্যে নেপাল, ভুটান, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সম্মতি দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রিসভা এই স্যাটেলাইট কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সম্মতি দিয়েছে। তবে শর্ত দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যেটা উৎক্ষেপণ হবে তার কার্যক্রমে এ স্যাটেলাইট বাধাগ্রস্ত করবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটার (সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট) লোকেশন অনেক দূরে। একটা (বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট) ১১৯ ডিগ্রি ইস্ট (পূর্বে), আরেকটা (সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট) ৪৮ ডিগ্রি ইস্ট। শর্ত দেওয়া হয়েছে, আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে যেন কোনো কারণে এন্টারফেয়ার না করে।’
এছাড়া দ্বি-পাক্ষিক পুঁজি বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা চুক্তির সম্পূরক অংশ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত জয়েন্ট ইন্টারপ্রিটেটিভ নোটস স্বাক্ষরের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক পুঁজি বিনিয়োগ চুক্তি হয়। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বাইল্যাটারেল ইনভেস্টমেন্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড প্রোমোশন এগ্রিমেন্ট বা যেটাকে আমরা বিপা বলি।’
তিনি বলেন, ‘এই বিপা’র কোনো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। বিপা’র ব্যাখ্যা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য হয়। এজন্য এনালাইসিস বা এক্সপ্ল্যানেশন তৈরি করা হয়েছে। দুই পক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে- তা গৃহীত হয়েছে। মন্ত্রিসভা নোটসগুলোকে স্বীকার করে নিয়েছে যে, আমরা এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত।’
আগামী এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় জয়েন্ট ইন্টারপ্রিটেটিভ নোটস স্বাক্ষর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
আইসিটি গবেষণায় অনুদান বাড়লো: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিখাতে (আইসিটি) গবেষণার জন্য ফেলোশিপ এবং উদ্ভাবনীমূলক কাজের জন্য সরকারি অনুদান বাড়াতে এ সংক্রান্ত নীতিমালায় সংশোধনী এনেছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ এবং উদ্ভাবনীমূলক কাজের জন্য অনুদান প্রদান সম্পর্কিত (সংশোধন) নীতিমালা- ২০১৬ এর খসড়ার কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুদানগুলো একটু বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন- বিদেশে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মাস্টার্স কোর্সে মাসিক ৩০ হাজার টাকার সমপরিমাণ ইউএস ডলার দেওয়া হবে, যেটা আগে নির্দিষ্ট করা ছিল না।’