এম জসীম উদ্দিন: প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের স্বদেশে প্রেরিত অর্থকেই রেমিট্যান্স বলে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স। আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হয়ে কাজ করছে রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সের অর্থ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। আর এই রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের অর্থনীতি আজ এত শক্তিশালী। বিশ্বমন্দা এবং স্থানীয় নানা সমস্যা সত্ত্বেও অর্থনীতির যে সেক্টর নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, তা হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স।
যাদের জন্য আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেই প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি অংশ নারী শ্রমিক। এরই মধ্যে গার্মেন্ট বা গৃহকর্মী ছাড়াও অন্যান্য পেশায় আরও বেশি নারী কর্মী পাঠানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিদেশে গমনকারী নারী কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রবাসে কাজ করছেন বাংলাদেশের প্রায় ৯ লাখ নারী রেমিট্যান্স যোদ্ধা। প্রবাসী বাংলাদেশি নারী কর্মীরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করলেও তাদের প্রবাসে যাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। প্রবাসে কর্মরত নারী কর্মীরা বিশ্বের নানা দেশে অবস্থান করে রেমিট্যান্স অর্জন করে দেশে পাঠাচ্ছেন, যা উন্নয়নে অবদান রেখে চলছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে বিদেশে নারীদের কর্মসংস্থান শুরু। ১৯৯১ সালে মাত্র দুই হাজার ১৮৯ নারী বিদেশে গিয়েছিলেন। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রতি বছর এক লাখের কাছাকাছি হয়। বাংলাদেশ নারী অভিবাসী শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, নারী কর্মীদের বিদেশে যাওয়া খুবই ইতিবাচক। পুরুষ প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের আয়ের ৬০ শতাংশ দেশে পাঠালেও নারীরা পাঠান ৯০ শতাংশ। নারী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের এখন যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়। ফলে তারা অনেক দক্ষ হয়ে উঠছেন।
নারী কর্মীদের নিরাপদ, নিয়মিত ও নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন গৃহকর্ম পেশায় বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মক্ষম নারী কর্মীদের বয়স ২৫-৩৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের কমপক্ষে তৃতীয় শ্রেণি পাস হতে হবে, যেন তারা নাম, মোবাইল নম্বর লিখতে পারে। তাদের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তাদের সমস্যা ও অভিযোগ দ্রুত সমাধানের জন্য বিএমইটিতে অভিযোগ সেল গঠন, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহে অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রবাসবন্ধু কলসেন্টার চালু করাসহ বিদেশস্থ ৩০টি শ্রমকল্যাণ উইং সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা ও ওমানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে চারটি সেফ হোম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হাউস কিপিং কোর্সের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আরও সহজতর ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ই-লার্নিং প্রশিক্ষণের আওতায় মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। গৃহকর্ম পেশা ব্যতীত আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে গার্মেন্ট ট্রেডে ৩৭টি টিটিসিতে ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। অসুস্থ নারী কর্মীদের সংশ্লিষ্ট দেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি প্রয়োজনে দেশে ফেরত এনে চিকিৎসা করা এবং এ খাতে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য দেয়া হচ্ছে। বিদেশে নারী কর্মীদের অভিবাসন নিরাপদ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ নারী কর্মী পাঠানোর জন্য অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্টের প্রাক-যোগ্যতা হিসেবে ওই রিক্রুটিং এজেন্টের অতীত কার্যক্রম, সুনাম, বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যাসহ অন্যান্য বিষয়কে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাছাড়া নারী কর্মীদের সুরক্ষায় নারী কর্মী পাঠানোর অনুমোদনপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্টের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা জামানত রাখা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের ৪২টি জেলায় বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের সেবা সহজ করার লক্ষ্যে ফিঙ্গার প্রিন্ট কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। ফলে ওই ৪২ জেলার কর্মীদের ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য ঢাকায় আসার প্রয়োজন হয় না। এছাড়া কর্মীদের সঠিক পন্থায় বিদেশ গমন এবং গন্তব্য দেশের আবহাওয়া, কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যবিধি, আইন-কানুন/বিধি-বিধান, করণীয় বা বর্জনীয়, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণ, উপার্জিত অর্থের সঠিক বিনিয়োগ প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা প্রদানের জন্য ৬০টি টিটিসি ও ছয়টি আইএমটিতে প্রি-ডিপারচার ট্রেনিং (পিডিটি) পরিচালনা করার পাশাপাশি অনলাইনে ভিসা চেকিং সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে নারী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কমানো এবং রিক্রুটিং এজেন্টগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৭ এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে কভিড-১৯ মহামারিকালে বিদেশ প্রত্যাগত নারী অভিবাসী কর্মীদের পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যার মেয়াদকাল ২০২১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য বিদেশ প্রত্যাগত নারী কর্মীদের পুনর্বাসন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণে সহায়তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পরিবারের টেকসই উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনয়ন, সন্তানদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি, বিদেশে অর্জিত দক্ষতা জ্ঞান কাজে লাগানো এবং সাইকো সোশ্যাল সাপোর্টের সুযোগ সৃষ্টি করা। এই কর্মসূচি তাদের অধিক পরিমাণে রেমিট্যন্স পাঠাতে উৎসাহিত করবে। দেশে ফেরত আসার পর দেশের কর্মসংস্থানের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়া তাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের কর্মসংস্থানের সঙ্গে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের মনঃসামাজিক অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব হবে। এ কর্মসূচিতে তথ্য যাচাই-বাছাই, চূড়ান্তকরণ, প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণ করার পাশাপাশি এককালীন প্রণোদনা প্রদান করা হয়। এরই মধ্যে কভিড-১৯ মহামারিকালে ৬২ জেলার বিদেশ প্রত্যাগত ৯৫০ নারী অভিবাসী কর্মীকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে (সূত্র: প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর)। প্রবাসী বাংলাদেশি নারী কর্মীদের দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা কর্তৃক অপারগতা প্রকাশ অথবা খরচ বহনে আর্থিক অসামর্থ্যরে কারণে তাদের দেশে ফেরত আনার খরচ কল্যাণ বোর্ড বহন করে থাকে। এর বাইরেও প্রতি অর্থবছর নারী কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনের বোর্ড থেকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের তিনটি আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রবাসী কল্যাণ শাখার মাধ্যমেও জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার কাজ চলছে। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তরের ফেসবুকে ও প্রবাস বন্ধু কল সেন্টারের মাধ্যমে নিরাপদ অভিবাসনের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য অবহিত করা এবং জিজ্ঞাসার উত্তর প্রদান করা হয়। সর্বোপরি অভিবাসী নারী কর্মীদের সেবা প্রদানের জন্য বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে শ্রমকল্যাণ উইংয়ের সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৩০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। অসচ্ছল প্রবাসী কর্মীর সন্তানকে শিক্ষিত জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে তাদের মেধাবী সন্তানদের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে ২০১২ সাল থেকে পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি অথবা সমমান ক্যাটেগরিতে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
নারীরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য পরিবার ও আত্মীয়স্বজন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশের অর্থনীতি ও নিজেদের অর্থনৈতিক ভাগ্য পরিবর্তন করতে গিয়ে এই নারীদের ক্ষেত্রবিশেষে চড়া মূল্য দিতে হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার মধ্যে গ্লানি আর একাকিত্বের কষ্ট থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খোঁজে। তাই বর্তমান সরকার নারীদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত নারীদের সহায়তায় উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ফলে প্রবাসে কর্মরত নারীরা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই স্বস্তি আর নিরাপদে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসে গমনেচ্ছু ও অবস্থানকারী নারী কর্মীদের আরও সচেতন, দক্ষ ও সরকারের এ-সংক্রান্ত সব সেবার বিষয়ে অবগত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
পিআইডি নিবন্ধ