ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদন ও ব্যয় দুই পদ্ধতিতেই জিডিপি ও প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এ দুই পদ্ধতি থেকে প্রাপ্ত ফল কাছাকাছি থাকে। তবে গত অর্থবছর এ দুই হিসাবে দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিক ব্যবধান। উৎপাদন পদ্ধতির হিসাবে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ২৪ শতাংশ। আর ব্যয়ের ভিত্তিতে করা হিসাবে এ থেকে বিচ্যুতি দুই দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এটি উৎপাদন পদ্ধতির হিসাব থেকে বাদ দিলে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ২১ শতাংশ। আর উৎপাদন ও ব্যয় পদ্ধতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের দুই দশমিক শূন্য তিন শতাংশ বিচ্যুতি শতাংশের হিসাবে রূপান্তর করলে ব্যবধান দাঁড়ায় ২৮ শতাংশের বেশি, যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে এমন উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থনীতির ভাষ্যমতে, দুই আর্থিক বছরের মধ্যে একটি দেশে যে পরিমাণ জিডিপি বৃদ্ধি পায়, তা নির্দেশ করে প্রবৃদ্ধি। তবে এ প্রবৃদ্ধি মূলত আর্থিক প্রবৃদ্ধি। ফলে এ থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে প্রাক্কলন করা হয় প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার। উৎপাদন ও ব্যয়ের ভিত্তিতে জিডিপি সমান হওয়ায় দুই হিসাবে প্রবৃদ্ধিও সমান হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি বা অমিলের গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাঁচ শতাংশ। এক্ষেত্রে ২৮ শতাংশ বিচ্যুতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তা বরাবরই অস্বীকার করা হয়েছে। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হিসাবে গরমিলে এটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণ করে গত সপ্তাহে জিডিপির খাতভিত্তিক হিসাব প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, উৎপাদন পদ্ধতিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সাত দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে ব্যয়ের ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পাঁচ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ দুই পদ্ধতিতে প্রবৃদ্ধির হারের পার্থক্য দুই দশমিক শূন্য তিন শতাংশীয় পয়েন্ট, যা পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি বা অমিল হিসেবে দেখানো হয়েছে।
দুই পদ্ধতিতে প্রবৃদ্ধির হারের এ পার্থক্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎপাদন ও ব্যয় পদ্ধতির হিসাবের মধ্যে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ পার্থক্য গ্রহণযোগ্য। এর বেশি হলে সেটা অস্বাভাবিক।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। আর শিল্প খাত থেকে এসেছে তিন দশমিক ১৮ ও সেবা খাতের অবদান তিন দশমিক ৩১ শতাংশ। এছাড়া আমদানি শুল্কের অবদান শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে উৎপাদনের দিক থেকে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় সাত দশমিক ২৪ শতাংশ।
এদিকে ব্যয়ের দিক থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়। এ খাতের অবদান দুই দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর সরকারি খাতের ভোগ ব্যয়ের অবদান ছিল শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়া প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগের অবদান ছিল দুই দশমিক ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি এক দশমিক ৩৪ ও সরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি এক দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর রফতানির চেয়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ায় এ খাতের পার্থক্য প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক অবদান রেখেছে শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে ব্যয়ের দিক থেকে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ২১ শতাংশ। ফলে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় দুই দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিশ্বব্যাংক কেবল সেকেন্ডারি তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব প্রাক্কলন করে। আর আমরা মাঠপর্যায়ে জরিপ করে তার ফলাফলের ভিত্তিতে হিসাব করি। সুতরাং তাদের হিসাবের সঙ্গে আমাদের হিসাবের পার্থক্য থাকবেÑএটাই স্বাভাবিক। আর আমাদের দেশে অনানুষ্ঠানিক আর্থিক কর্মকাণ্ডের আওতা অনেক বড়। সেগুলো বিশ্বব্যাংকের হিসাবে কখনও আসে না। তাছাড়া মানুষ ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে প্রদর্শন করে না। সেজন্য ব্যয়ের হিসাব প্রাক্কলন করা কঠিন ব্যাপার। এসব কারণে পার্থক্য হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন ও ব্যয়ের দিক থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে কোনো পার্থক্য ছিল না। ফলে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য ছিল শূন্য। যদিও এটাকে সঠিক নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ দুই হিসাব পুরোপুরি মিলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি ছিল প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ। তবে এর আগের তিন বছরে প্রবৃদ্ধিতে পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি ছিল ছয়-সাত শতাংশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকাতে শুরু হয়েছিল উৎপাদনের ভিত্তিতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রাক্কলন। ১৯৩৪ সালে দেশটির অর্থনীতিবিদ সায়মন কুজনেট প্রথম এটি প্রচলন করেন। ধীরে ধীরে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জিডিপি পরিমাপে উৎপাদন পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়। আর ১৯৭৯ সাল থেকে পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। যদিও খোদ মার্কিন গবেষকরাই অনুধাবন করেন জিডিপি পরিমাপে উৎপাদন পদ্ধতি যথেষ্ট নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ অনেক দেশ এখন জিডিপি পরিমাপে আয় বা ব্যয় পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট সময়ে (এক বছরে) একটি দেশের ভেতর যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তার আর্থিক মূল্য নির্দেশ করে জিডিপি। উৎপাদন পদ্ধতিতে এর প্রতি স্তরে মূল্য সংযোজনকে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে কৃষি, সেবা ও শিল্প খাতের মূল্য সংযোজনকে প্রাক্কলন করা হয়। ব্যক্তিখাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ তথ্য পাওয়া সহজ হলেও সরকারের ব্যয়, আর্থিক খাত ও অদৃশ্য সম্পদ পরিমাপের ক্ষেত্রে এটি জটিলতা তৈরি করে। ফলে প্রচলন শুরু হয় ব্যয় পদ্ধতির।
নতুন এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি ও সরকারি ভোগ ব্যয়ের সঙ্গে এ দুই খাতের বিনিয়োগও যুক্ত হয়। পাশাপাশি রফতানিতে মূল্য সংযোজন যোগ করে আর বাদ দেওয়া হয় আমদানির হিসাব। তবে উৎপাদন ও ব্যয় পদ্ধতিতে জিডিপির হিসাব প্রায় সমান হওয়ার কথা। কিছু ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতির উদ্ভব হলেও তা পাঁচ-সাত শতাংশের বেশি হয় না।
Add Comment