Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:43 pm

প্রবৃদ্ধির সরকারি হিসাব মানছে না বিশ্বব্যাংক!

ইসমাইল আলী মাসুম বিল্লাহ: ২০১৯-২০ অর্থবছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কত হবেÑতা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে মতভেদ রয়েছে। করোনার কারণে অর্থবছরের শেষ চার মাস অর্থনৈতিক কার্যক্রম বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে প্রবৃদ্ধি অনেকটাই কমে যাওয়ার শঙ্কা করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে সরকারিভাবে দাবি করা হয়, করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেলেও সে হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ হবে খুবই কম।

যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রায় ১০ মাস পেরুলেও এখনও আগের অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তবে সংস্থাটি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে গত বছরের আগস্টে। তাতে বলা হয়েছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে তা গত অর্থবছরের ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্যের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সে সময় বলা হয়, অর্থবছরের শেষ তিন মাস (এপ্রিল-জুন) তথা করোনা সংক্রমণের পরের চিত্র সাময়িক হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পরই অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত হতে শুরু করে। আর ১৭ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যুর পর তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ থেকে দেশব্যাপী ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, শিল্প-বাণিজ্য ও সেবা খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩১ মে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করে সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেয় সরকার। তবে সাধারণ ছুটি তথা লকডাউনের প্রভাব অর্থনীতিতে এরপরও কয়েক মাস বিদ্যমান থাকে।

এদিকে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিপর্যয়ের চিত্র বিবেচনায় নিয়ে গত বছর ৮ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২০’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে এক দশমিক ছয় শতাংশ। যদিও অক্টোবরে তা কিছুটা বাড়িয়ে বলা হয়, প্রবৃদ্ধি হবে দুই শতাংশ।

আর গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট: এপ্রিল ২০২১’ প্রতিবেদনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার আরও কিছুটা বাড়িয়েছে বিশ্বব্যাংক। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির হার (প্রাক্কলিত) ধরা হয়েছে দুই দশমিক চার শতাংশ। তবে বিবিএসের প্রকাশিত সাময়িক হিসাব তথা পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাব গ্রহণ করেনি সংস্থাটি। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও বিবিএসের হিসাবের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পার্থক্যের মাত্রা খুঁজতে বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ ও বিবিএসের সাময়িক পর্যালোচনা করেছে শেয়ার বিজ। এতে খাতভিত্তিক (আয় ও ব্যয়) জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। আয় খাতের মধ্যে শুধু কৃষিতে প্রবৃদ্ধি প্রায় কাছাকাছি হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক ও বিবিএস। তবে অন্যান্য খাতে পার্থক্য অনেক বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য শিল্প খাতে।

আর ব্যয়ের দিক থেকে বিবেচনা করলে ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির পার্থক্য সবচেয়ে কম। আর সরকারি ভোগ ব্যয়ের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। এছাড়া আমদানি, রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হিসাবেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।

উৎপাদন তথা আয়ভিত্তিক জিডিপির হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক বলছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন শতাংশ, শিল্প খাতের এক দশমিক তিন শতাংশ ও সেবা খাতের তিন দশমিক চার শতাংশ। আর বিবিএসের সাময়িক হিসাবে, কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন দশমিক ১১ শতাংশ, শিল্প খাতের ছয় দশমিক ৪৮ শতাংশ ও সেবা খাতের পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এদিকে ব্যয়ভিত্তিক জিডিপির হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক বলছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে দুই দশমিক ছয় শতাংশ। তবে সরকারি খাতে ভোগ ব্যয়ে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। একইভাবে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে রপ্তানি ও আমদানি খাতে। এ দুই খাতে গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণাত্মক ও ১২ দশমিক ১ শতাংশ ঋণাত্মক। আর সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে সার্বিকভাবে বিনিয়োগ চার দশমিক তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

যদিও বিবিএসের সাময়িক হিসাবে গত অর্থবছর ব্যয়ভিত্তিক প্রতিটি খাতেই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক ৯৫ শতাংশ, সরকারি ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি সাত দশমিক ২৫ শতাংশ, বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক ৭১ শতাংশ, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক ৩১ শতাংশ ও আমদানি প্রবৃদ্ধি সাত দশমিক ৯১ শতাংশ।

সরকার ও বিশ্বব্যাংকের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবের মধ্যে এমন বড় ব্যবধানের কারণ কী হতে পারে সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, বিবিএস গত আগস্টের দিকে যখন প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছিল, তখন তারা জানিয়েছিল যে, সেখানে করোনা পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত হিসাব বিবেচনায় আনা হয়েছে। আর দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে ২০২০ সালের মার্চে। তার পরে জুন পর্যন্ত সময়ে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়েছে, তা ওই সাময়িক হিসাবে নেই বলে বিবিএস জানিয়েছিল। চূড়ান্ত হিসাবে তাদের প্রবৃদ্ধির হিসাব কমবেশি হতে পারে বলেও তখন উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক যে হিসাব দিয়েছে, তাতে করোনার প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করা হয়েছে। সে কারণে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ব্যবধানটা বেশি দেখা যাচ্ছে।’

এদিকে সাধারণত প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হয়। এবার সে সময় পেরিয়ে আরও কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও এখনও আগের অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব কেন প্রকাশ করা হচ্ছে নাÑসে বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদনের গ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই তা প্রকাশ করা হবে।