মন্দ মানের ঋণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে তাদের মন্দ ঋণগুলো আদায় করার ক্ষেত্রে যতœবান হয় এবং খারাপ শ্রেণির গ্রাহকদের ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হয়, সেটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই মূলত আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ঋণের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশিকা তৈরি করে থাকে। এসব নির্দেশিকা পরিপালন আইএমএফের সব সদস্য দেশের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশে এসব শর্ত পরিপালনে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের শৈথিল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
দৈনিক শেয়ার বিজে গতকাল ‘আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, কভিড মহামারির সময়ে খেলাপি ঋণের বিষয়ে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও সেটিকে খেলাপি হিসেবে দেখানো যাবে না বলে সরকার নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনার মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই দ্রুতগতিতে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এভাবে নির্দেশনা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সুফল ভালো হতে পারে না। এতে করে সাময়িকভাবে কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ কম থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।
খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ সালের পর থেকে হু-হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। যদিও এ বৃদ্ধির ধারা সবসমই পরিলক্ষিত হয়, তবে ২০০০ সালের পর থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছিল। মূলত আইএমএফের গাইডলাইন অনুযায়ী, ওই সময় কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার কারণে খেলাপি ঋণ কমে এসেছিল। বর্তমানে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেসব বিষয় ভূমিকা রেখেছে, সেসব বিষয়ে সংস্কার আনার বিষয়ে আবার আইএমএফ নির্দেশনা দিয়েছে। সরকার এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে খেলাপি ঋণের রাশ টানা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
আইএমএফের শর্তের মধ্যে রয়েছে, একই পরিবার থেকে দুজনের অধিক ব্যক্তিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে না রাখা, পরিচালক পদে একাধিক্রমে তিন বছর করে পরপর দুই মেয়াদের বেশি না থাকা প্রভৃতি। এসব বিষয় একসময় বলবৎ ছিল। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে একটি বিল আনয়ন করে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের মাধ্যমে এক পরিবার থেকে চার সদস্যের পরিচালক পদে অন্তর্ভুক্তি এবং একাধিক্রমে ৯ বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ করে দেন। এ সুযোগ ব্যাংকে মন্দ মানের ঋণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কাজেই যেসব আইনি বিধান আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেগুলো সংশোধন করা উচিত বলে মনে করি। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবীক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করে মন্দ গ্রাহকদের ঋণদান বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।