আরাফাত রহমান: উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুকে গর্বের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মা সেতু। অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সেতুটির বর্তমান অবস্থানের পেছনের ইতিহাস অত্যন্ত চমকপ্রদ ও ঘটনাবহুল। পদ্মা সেতুটি একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় ও চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প।
দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান ইতোমধ্যে বসানো সম্পন্ন হয়েছে। ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি আগেই জানিয়েছিল, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
২০০৮-০৯ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠিয়ে বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এমন কোনো অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ-পরবর্তী সময়ে আদালতে খণ্ডিত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখন কোনো প্রকার বিদেশি সাহায্য ছাড়াই প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত নেন।
এইকমের (AECOM) নকশায় পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। সে সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
পরে নদী শাসন ও পাইলিংয়ের জটিল কাজের কারণে পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়ায় সব মিলিয়ে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) ২০১০ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণকাজ আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি তিনটি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করছেÑমুন্সীগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট/উত্তর পাড়), শরীয়তপুর এবং মাদারীপুর (জঞ্জিরা/দক্ষিণ পাড়)। এটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর সম্পূর্ণ নকশা করার জন্য এইকমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করা হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ প্যানেল সেতুর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তা, নকশা পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে। পদ্মা সেতুর ভৌত কাজকে মূলত পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছিল। যথাÑ(ক) মূল সেতু, (খ) নদী শাসন, (গ) জাজিরা সংযোগকারী সড়ক, (ঘ) টোল প্লাজা এবং (ঙ) মাওয়া ও জাজিরা সার্ভিস এলাকা।
প্রকল্পে নিয়োজিত নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল-এইকম’ ভৌত কাজের ঠিকাদার নিয়োগের প্রাক-যোগ্যতা দরের নথি প্রস্তুত, টেন্ডার আহ্বানের পর টেন্ডার নথি মূল্যায়ন, টেন্ডার কমিটিকে সহায়তাসহ এ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ তদারক করতে নিয়োজিত ছিল। ভৌত কাজের বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি।
প্রথম দিকে পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের। তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পরে সমস্যা দেখা যায়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করে। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের এ পদ্ধতিতেই বসানো হয় পদ্মা সেতু। এরকম পদ্ধতির ব্যবহারের নমুনা বিশ্বে তেমন একটা নেই।
এ প্রক্রিয়ায় ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে কেমিক্যাল নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়েছে। তারপর ওই মাটিতে গেঁথে দেয়া হয়েছে পিলার। এমন পদ্ধতির প্রয়োগ বাংলাদেশে এই প্রথম। এ পদ্ধতিতে পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েল্ডিং করে দেয়া হয়। পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। কেমিক্যালের প্রভাবে তখন তলদেশের সেই মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। একপর্যায়ে সেই মাটি পাইলের লোড বহনে সক্ষম হয়ে ওঠে। তখন আর পাইল বসাতে কোনো বাধা থাকে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা প্রভৃতি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়। ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সালে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩তম পিলারে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। ২৩ আগস্ট ২০২১ সর্বশেষ সড়ক সø্যাব বসানো হয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা সেতু নির্মাণে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার ও চীনা চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে চীনের কোম্পানিটি পদ্মা সেতুর কার্যাদেশ পায়।
পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১০ সালে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হলে সেখানে প্রি-কোয়ালিফিকেশনের জন্য ৪০টি কোম্পানি অংশ নেয়। বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবির তত্ত্বাবধানে এদের মধ্যে ৫টি কোম্পানিকে বাছাই করা হয়। পরে বিশ্বব্যাংকের আপত্তির কারণে একটি কোম্পানি বাদ পড়ে যায়। আর্থিক প্রস্তাব আহ্বান করলে শুধু চীনের এ কোম্পানিটি আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়। এটি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন একটি কোম্পানি। কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিস্তরের পদ্মা বহুমুখী সেতুর সব কাজ প্রায় সম্পন্ন। মূল সেতুর জন্য নিযুক্ত চীন মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (এমবিইসি) কাজটি সম্পাদন করেছে। নদী প্রশিক্ষণের জন্য চার মাস ধরে মাটি পরীক্ষা ও ড্রেজিংয়ের কাজ চলেছে। ব্রিজটিতে মোট পিলার আছে ৪২টি। প্রত্যেক পিলারের নিচে ছয়টি পাইল। স্তম্ভগুলোয় ইস্পাত স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। ব্রিজটির মোট ৪১টি স্প্যান।
চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন নদীর প্রশিক্ষণ কাজের জন্য নিয়োগ পেয়েছিল এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি দেয়া হয়। অক্টোবর ২০১৭ সালে, মূল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময় পরে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর, ৪২টির মধ্যে ৪২টি পিলারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই সেতুর সর্বশেষ (৪১তম) স্প্যানটি বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি করেছে। এই সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ ভাগ অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটিতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সেতুটি কার্যকর হলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
সহকারী কর্মকর্তা
ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়