প্রযুক্তিতে কর্মব্যাপ্তি ও নেটভিত্তিক লেনদেনে সময়, ব্যয়-সাশ্রয়

মিজানুর রহমান: অ্যাপ ও ইন্টারনেটভিত্তিক লেনদেন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় যখন বিপর্যস্ত তখন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদ উল্লাহ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন যেভাবে: বন্যার খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করে ৩৫০ মেট্রিক টন খাবারের অর্ডার দিয়ে ফেলেছিলাম। ফান্ডে তখন এক টাকাও নেই। এটুকু বিশ্বাস ছিল আল্লাহ আমাদের ফিরাবেন না। আলহামদুলিল্লাহ, ৩৫০ মেট্রিক টনের জায়গায় ৭০০ মেট্রিক টনের খাবারের ব্যবস্থা আল্লাহ পাক করে দিয়েছেন।’ তাই দেখা যায় এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য তাৎক্ষণিক অনুদানের অর্থ সংগ্রহ করতে কারও কাছ থেকে নগদ ক্যাশ কিংবা দ্বারে দ্বারে যেতে হয়নি। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষ এমএফএস, ব্যাংকিং অ্যাপস ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অনুদান পাঠিয়েছিল; যা ছিল সময় সাশ্রয়ী ও ব্যয়-সাশ্রয়ী।

বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাংক ব্যবস্থার অতীতের দিকে যদি তাকাই, একসময় বাংলাদেশে কোনো বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ছিল না এবং ছিল না কোনো মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা এমএফএস। প্রচলিত সরকারি ব্যাংকগুলোই বাজারে ব্যবসা করত। ১৯৮৩ সালে ভিন্ন চিন্তার উদ্যোক্তারা নতুন ব্যাংকিং ব্যবসায় আগ্রহ প্রকাশ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক উন্নত গ্রাহক সেবার নিমিত্তে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি লাভ করে। তখন দেখা যায় ব্যাংকগুলো সবাই কম্পিউটারায়িত ব্যাংকিং সেবা দিতে শুরু করে। ফলে ব্যাংকিং সেবা সম্পর্কে মানুষের ধারণাই পাল্টে যায়। গ্রাহকেরা অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ প্রদান করেও এসব ব্যাংকে এসে ভিড় করতে থাকে। আর আধুনিক মানের এ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মুনাফা অর্জনের দিক থেকে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তারা বহুমাত্রিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠানের অপারেটিং ব্যয়ের পাশাপাশি গ্রাহকদের স্বল্প সার্ভিস চার্জে সেবা প্রদানে সচেস্ট থাকে। আর ব্রাঞ্চে না এসে প্রথাগত ফিজিক্যাল ব্যাংক থেকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে যুগোপযোগী সেবা দানে বিকল্প চিন্তাভাবনা ও ইনোভেশন চলমান রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রণয়ন করেন অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল (এডিসি)। মূলত এরপরই বেগবান হতে থাকে একটির পর একটি কম্পিউটারায়িত ইন্টারনেট ভিত্তিক নতুন সেবা। এসব সেবার মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ই-ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, ২৪/৭ এটিএম বুথ, ই-কমার্স, পয়েন্ট অব সেল, ডিজিটাল ব্যাংকিং, কিউআরের মতো ইত্যাদি সেবাগুলো।

সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেলে যুক্ত হতে থাকে নতুনত্ব ও গ্রাহকবান্ধব বহুমাত্রিক ইন্টারনেট ভিত্তিক সার্ভিস। এগুলোর মধ্যে সরকারে স্বয়ংক্রিয় চালান সিস্টেম (এ-চালান পদ্ধতি) ও ই-জিপি। পূর্ব থেকেই আন্তঃব্যাংক গ্রাহক সেবার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করেন এনপিএসবি-ডিসপিউট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এছাড়াও ভিসা, মাস্টার, স্থানীয় কিউ-ক্যাশ নেটওয়ার্কের লেনদেন ও সমন্বয়, অ্যাপ ভিত্তিক আইবিএফটি, এমএফএসে ফান্ড ট্রান্সফার, ই-পেমেন্ট সলিউশন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট পার্টনারশিপ প্ল্যাটফর্ম, আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের ডেবিট কার্ড, স্মার্ট অ্যাপ, ফোন ব্যাংকিং তথা কন্টাক্ট সেন্টারসহ ইত্যাদি ডিজিটাল সার্ভিস। এরূপ ব্যাংকিং সার্ভিসগুলো অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সেবা প্রদান করে। আর যেসব ব্যাংকের অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল থেকে একযোগে সেবাগুলো দিয়ে থাকে শুধু সেই বিভাগগুলোকে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা নামকরণে যথার্থ এবং ইনোভেটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবিক ও আদর্শ মনে করেন।

ইন্টারনেটভিত্তিক আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাংকিং সেবা হলো মোবাইল অ্যাপ। যদিও ১৯৯৯ সালে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন চালুর পর জার্মানিতে ডয়চে ব্যাংক কর্তৃক সর্বপ্রথম মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করে। আর অ্যাপ
তৈরির ইতিহাস আলোকপাত করলে দেখা যায় ২০১১ সালে রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড সর্বপ্রথম ফাংশনাল ব্যাংকিং অ্যাপ চালু করেন। মূলত এরপর থেকেই বাংলাদেশেও ডেস্কটপ পিসি নির্ভর ইন্টারনেট ব্যাংকিং থেকে ধীরে ধীরে মোবাইল অ্যাপ এর যুগে প্রবেশ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা এমএফএস ছাড়াও অ্যাপের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে উবার, পাঠাও রাইড শেয়ারিং, ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন, এজেন্ট ব্যাংকিং, মাইক্রো মার্চেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে অনলাইন ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়ে কর্মসংস্থান সুযোগের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এ ধরনের সেবা ও লেনদেনে সময় ও ব্যয় কমার ফলে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং সারাদেশে ডিজিটাল কর্মকাণ্ড বিস্তার করে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে ২০১৩ সাল থেকে অ্যাপ সেবা চালু করে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া সকলেরই অ্যাপস আছে।

কোন ব্যাংকের অ্যাপ কত সহজ, স্মুথ সার্ভিস, ইউআইইউএক্স, লোডিং টাইম, ডাটা সিকিউরিটি ইত্যাদ অথেন্টিকেশন ফিচার যুক্ত করার মাধ্যমে গ্রাহকদের নজর কারার জন্য চলছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক নিবিড় প্রতিযোগিতা। এই বহুমুখী প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং অ্যাপস সেবার মাধ্যমে ব্যাংকিং আর ব্যাংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, খুব সহজে ঘরে বসেই প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সংক্রান্ত লেনদেন সম্পন্ন করা যায়। যার প্রকৃত শিক্ষা ও উদাহরণ কভিড-১৯ কালীন। তাই বলা যায় ব্যাংক এখন হাতের মুঠে। আর সার্ভিস যেন তর্জনীর ডগায়। অথচ এক সময় মানুষ ধারনা করতো ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে গ্লোবাল কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে। আশঙ্কা ছিল অনেকেই কাজ হারাবে কিংবা বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তবে এ ধারণা একেবারেই ভিন্ন। অনেক আগে আগামী দিনের কাজ সম্পর্কে নানা গবেষক ইতিবাচক বর্ণনা দেন। এর মধ্যে জগৎ খ্যাত ও ব্যাপক আলোচিত আর্মেনিয়ার বিসিজি সিনিয়র পার্টনার ও গ্লোবাল লিডার ফর ডিজিটাল গভর্নমেন্ট মিগুয়েল কারারসকো বলেন, প্রযুক্তি নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে, কর্মসংস্থান হ্রাস করে না। তার বিশ্লেষণটা ছিল এমন: মোট কাজগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশ থাকবে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ২০ শতাংশ করবে আধুনিক প্রযুক্তি আর বাকি ৭০ শতাংশ সম্পন্ন করার জন্য মানুষকেই লাগবে। অন্যত্র গবেষণাধর্মী অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম কোরসেরার বৈশ্বিক দক্ষতা সূচক বা ‘গ্লোবাল স্কিলস ইনডেক্স (জিএসআই) অনুযায়ী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ইতিবাচক ধারণা পাওয়া যায় এমন: প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ।


তথ্যপ্রযুক্তি এ যুগের শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। তাই ২০১৩ সালের এপ্রিলে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রযুক্তিনির্ভর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণাটি উপস্থাপিত হয়েছিল। আর তখন থেকেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব
ধাবিত হয় উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান প্রদানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্কিং জাল, যা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত অনেকগুলো কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সমষ্টি। এর আলোকে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ক্ষেত্রে আবিষ্কার ও জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়াও গত কয়েক দশকে ইন্টারনেট সেবার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের আধুনিক জীবন ও কর্মব্যবস্থায় এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে গ্রথিত। যেন এর একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন হলে সবকিছু অচল হয়ে পড়ে। এমনকি ইন্টারনেটবিহীন শক্তিশালী চিন্তা, গবেষণা, মননশীলতা, ইনোভেশন সবকিছু অকল্পনীয় আর এটাই বাস্তব। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮০ সালের শেষদিক থেকে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (আইএসপিআর) আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে যা দ্রুতই দেশের প্রতিটি স্তরে অভিনব বৈপ্লবিক পরিবর্তন রচনা করে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এর শুরু আছে কিন্তু সাফল্যের চূড়ার সীমানা কতটুকু তা কোনোভাবেই বলা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে কল্পনার বাইরে নতুনত্ব প্রযুক্তি ও আপডেট যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে নব উদ্ভাবিত এবং স্বয়ংক্রিয় সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।

সুতরাং প্রযুক্তির ব্যবহার কর্মক্ষেত্রে কাজ হারানোর চিন্তা থাকলেও পক্ষান্তরে প্রতিযোগিতার এ যুগে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির সম্ভাবনা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র পথ তথ্যপ্রযুক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। আর এ প্রতিযোগিতায় বিশ্বব্যাপী যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আছে, ব্যাংক তাদের মধ্যে অন্যতম। ব্যাংক ছাড়া পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নির্মাণ অসম্ভব। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে আরও কর্মক্ষম বাংলাদেশ, আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাংলাদেশ, আরও ন্যায়সঙ্গত বাংলাদেশ। তাই ব্যাংক যেমনি প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে গ্রাহকদের নিরাপদ ও স্বস্তিতে রাখতে আপডেটের পাশাপাশি মৌলিক সেবাগুলো প্রদানে সহজ, উন্নত ও সাশ্রয়ী করতে বদ্ধপরিকর। তেমনি গ্রাহকদেরও উচিত ভবিষ্যতে অধিকতর শক্তিশালী ও সমৃদ্ধতর বাংলাদেশ নির্মাণে এবং উন্নত সেবা গ্রহণ ও বিস্তারে ডিজিটালে অভ্যস্ত হওয়া এবং প্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি জ্ঞান অন্বেষণ করে নিকটজনকে অনুপ্রেরণা দেয়া।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০