ইসমা খাতুন: বর্তমান বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ফলে জীবনযাত্রার মানের অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির কারণে আজ তথ্য ও প্রযুক্তির যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তথ্য ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে মানুষ যেমন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করছে, তেমনি এর অপব্যবহারের ফলে নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা ভ্রান্ত পথে এগোচ্ছে।
কারও কারও জীবনে নেমে এসেছে দুর্বিষহ অন্ধকার। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে। এটি ছাড়া এক দিনও অতিবাহিত হয় না আমাদের। গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমানে শতকরা ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে চার ঘণ্টা করে কোনো না কোনো প্রযুক্তিনির্ভর স্ক্রিনের সামনে সময় ব্যয় করে।
অন্যদিকে আমাদের কাছ থেকে এ প্রযুক্তি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য ও প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের অবস্থান কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? এর অপব্যবহার করে শিশু-কিশোররা এক অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে অকল্যাণকর পথে, অপরাধ জগতে।
এ জগতে তরুণ প্রজšে§র শিশু-কিশোররা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে ৮০ শতাংশ শিশু ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, নতুন কারিকুলাম শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রামের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরই হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে স্মার্টফোন। কিন্তু গ্রামের অশিক্ষিত অভিভাবক এর অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় তারা খুব সহজেই অপরাধ জগতে ঢুকে পড়ছে। এক জরিপে দেখা গিয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিশুদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ব্যবহার করছে শুধু বিনোদনের জন্য এবং ৩৬ শতাংশ শিশু শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে। তাহলে শিক্ষামূলক ব্যতীত ৬৪ শতাংশ শিশু ইন্টারননেট ব্যবহার করে শুধু কি সুস্থ বিনোদনের মধ্যেই অনলাইনে থাকছে না কি খারাপের দিয়ে ধাবিত হচ্ছে, তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তথ্য ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে শিশু-কিশোররা আসক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন গেমস, পর্নোগ্রাফি, কিশোর গ্যাং, তথ্যচুরি, ব্ল্যাকমেইলিং, অবৈধ হ্যাকিং এবং জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদে। ২০২০ সালে ডিএসপি সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যান তথ্য হতে জানা যায়, ১৮ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ৭ শতাংশ, ১৯-২৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর নারী-পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে তিন শতাংশ তথ্য ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়াচ্ছে।
শিশুরা অনলাইন গেমস যেমনÑফ্রিফায়ার, পাবজি প্রভৃতিতে ব্যস্ত থাকায় শিশুর বিকাশ সাধনে ব্যাঘাত ঘটে। তারা পড়াশোনায়ও পিছিয়ে পড়ে। বিষয়টি আলোচনায় আসায় কর্তৃপক্ষ এ গেমসগুলো বন্ধ করে দেয়। বর্তমান সময়ে দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে ২৬০০ জিবিপিএস ব্র্যান্ডউইথ, যার ৫০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে টিকটক, লাইকি, ফ্রিফায়ার, পাবজি অনলাইন গেমস ইত্যাদিতে। আর এতে করে শিশু-কিশোর পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
এমনকি পরিবারগুলোয় দেখা যায়, ছেলে এক কক্ষে মেয়ে আরেক কক্ষে মুঠোফোনে ব্যস্ত, ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করছে তারা। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা আসলে সৌজন্যটুকু করতে তারা অনাগ্রহী। বস্তুত, সে যে মুঠোফোনে কোন জগতে চলে গেছে তার খবর কি অভিভাকরা রাখছে? মূলত শিশুটি দিন দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন থেকে। এর ফলে সামাজিকভাবেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। তথ্য ও প্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকের শিশু-কিশোররা ক্রমাগত আসক্ত হয়ে পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মানসিক রোগে বা ডিপ্রেশনে। তাছাড়া তথ্য হ্যাকিং সম্পর্কিত ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতাটি বেশি লক্ষ্য করা যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে আমাদের তরুণ সমাজ উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, হানাহানিও প্রযুক্তির অপব্যহারের মাধ্যমে হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ অপব্যবহার বন্ধে এখনই আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের সচেতন মহল এগিয়ে এলে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমাদের শিশু-কিশোর ও যুবসমাজ রক্ষা পেতে পারে। সাইবার অপরাধে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা সমাজব্যবস্থা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা, মানবিকতা নান্দনিকতার বিকাশ, উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। এ দুর্বিষহ পরিস্থিতি এড়াতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
আমরা কিছুতেই তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করতে পারব না। তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা এগিয়ে যাব। তবে এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে পারিবারিকভাবে মা-বাবা ও অভিভাবকদের। তথ্য ও প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরতে হবে। শিশুদের প্রচুর সময় দিতে হবে অভিভাবকদের। তাদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তথ্য ও প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়, শিক্ষণীয় পথে পরিচালিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মুঠোফোন, ট্যাবলয়েড ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, কম্পিউটার ব্যবহার সম্পর্কে খারাপ ও ভালো দিকগুলো অবহিত করতে হবে। আবার বিনোদনের জন্যও তাদের কিছুটা সময় দিতে হবে।
কিন্তু অভিভাবক এবং মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে শিশু ভ্রান্ত পথে যাচ্ছে কি না। বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের তথ্য ও প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দিক তুলে ধরতে হবে। যেহেতু এখন শিক্ষাব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর, শিশুদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দেয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে, শুরু হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠদান। আইসিটি বিভাগ শিশুদের কন্টেন্ট তৈরি করছে। সুতরাং শিক্ষকদের তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে পরিচালিত করার সুযোগ রয়েছে। তাই প্রযুক্তির এই ভয়াবহ থাবা থেকে যুবসমাজকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে সর্বস্তরের সচেতন হতে হবে।