প্রশিক্ষিত জনসংখ্যা আমাদের সম্পদ

সেলিনা আক্তারঃ জনসংখ্যা-যা সারা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি মৌলিক উপাদান। এই ধারণাটি কখনও একটি রাষ্ট্রের সম্পদ আবার কখনও একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্তরায়, যদি না এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা না যায়। তবে জনসংখ্যা কেবল সমস্যা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৮১০ কোটি। বিভিন্ন দেশ এবং মহাদেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং হ্রাসের ধরন বিভিন্ন রকম। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে জনসংখ্যা ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের তথ্য অনুযাযী, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯৭০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই বৃদ্ধির কম-বেশি ৫০ শতাংশ এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭০ মিলিয়ন। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৯০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে।

একটি দেশের জনগণ তথা সাধারণ গণমানুষ দেশটির প্রধান চালিকাশক্তি বা প্রাণশক্তি। আর সে প্রাণের প্রকাশ বা স্পন্দন মনোরম হতে পারে যদি মানুষ সাধারণ খাদ্যে-স্বাস্থ্যে-শিক্ষায় সবল ও কর্মক্ষম থাকে। সমৃদ্ধ একটি দেশ নির্মাণ তাহলেই সম্ভবপর হয়। জনসংখ্যা বাড়া-কমার গুরুত্বপূর্ণ সূচক টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর। সহজ কথায়, একজন নারী তার সমগ্র জীবনে গড়ে যতজন সন্তানের জš§ দেন, তার হিসাবই হচ্ছে টিএফআর। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কম। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে জš§হার কম এবং মৃত্যুর হার বেশি। ইউরোপিয়ান কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের জনসংখ্যা ৫০ মিলিয়ন হ্রাস পেতে পারে। জার্মানির (টিএফআর) জš§হার প্রতি মহিলার জন্য ১ দশমিক ৫ শিশু, যা জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ইউরোপের দেশেগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বয়স্ক নাগরিক হবে, যা বর্তমানে প্রায় ২০ শতাংশ। এই বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে। বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যা দিন দিন কমছে। এটি অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা এবং পেনশন সিস্টেমের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৪৫ মিলিয়নের মতো কমতে পারে। ইউরোপের মতো উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। যুক্তরাষ্ট্রের জš§হার প্রতি মহিলার জন্য ১ দশমিক ৭ শিশু (টিএফআর), প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতার জন্য পর্যাপ্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় অভিবাসনের কারণে জনসংখ্যার বৃদ্ধি কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। অভিবাসনের ফলে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতেও বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ বয়স্ক, যা ২০৫০ সালের মধ্যে ২২ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে মূলত উচ্চ জš§হার এবং কম মৃত্যুহারের কারণে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে এশিয়ার দুটি বৃহৎ দেশ হলো ভারত ও চীন। ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন। ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা হবে কম-বেশি ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন। আর কিছু দিনের মধ্যেই চীনকে অতিক্রম করে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হয়ে উঠবে। চীনের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন। চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম ফলে বয়স্ক জনসংখ্যার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা কমে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে চীনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে পারে। আমাদের আয়তন সীমিত, আমাদের উৎপাদন সীমিত। সে হিসাবে আমাদের দরকার জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করা। জনসংখ্যার বিচারে আমাদের দেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে। কোথাও কোথাও আবার নবমও উল্লেখ করা হয়েছে।

গত আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটিরও বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও জনবিন্যাসের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণত টিএফআর-এর মান ২ দশমিক শূন্য কিংবা তার নিচে হলে সেটি ‘প্রতিস্থাপনযোগ্য হার’ হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক নারীর সন্তানসংখ্যা গড়ে ২ দশমিক শূন্য হলে পরবর্তী প্রজšে§ও দেশের জনসংখ্যা মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের টিএফআর হয়েছে ১ দশমিক ৯। প্রতিস্থাপনযোগ্য টিএফআর ২ দশমিক শূন্য এর চেয়ে নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশের ফার্টিলিটি রেট। যা আন্তর্জাতিক সূচকে ১১২তম। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের যত অর্জন হয়েছে তার মধ্যে টিএফআর নিঃসন্দেহে অন্যতম একটি অর্জন।

তবে বর্তমান বাংলাদেশে তরুণ প্রজšে§র সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অধিক হওয়ায় ২০৬৪ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়বে। এরপর আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৯টি দেশে: ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, আমেরিকা, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে প্রতি মিনিটে ২৫০ শিশুর জš§ হয়। বাংলাদেশে জš§গ্রহণ করে ১০টি শিশু। এক জরিপে দেখা গেছে যে, বর্তমানে জš§গ্রহণকারী ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৯৭ জন জš§গ্রহণ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।

বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে জনশক্তিকে আরও দক্ষ করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তরুণ যুব বেকারদের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে তাদের কাজে লাগাতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সিংহভাগ অঞ্চলের মাটিই উর্বর ও আবাদযোগ্য। তাই আমাদের কৃষিক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে উৎপাদন বৃদ্ধি করা আমাদের জন্য সহজ। কৃষি, খাদ্য এবং জš§নিরোধে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। কৃষিকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি বলা হচ্ছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষ বেশি, যারা কর্মক্ষম। দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু তাই নয় জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ সহজশর্তে ঋণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। যার জন্য দরকার সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।

বিশ্বে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৭ থেকে ৭১ বছর। ২০৪৫ থেকে ২০৫০ সালে এ গড় আয়ু দাঁড়াবে ৭৭ বছরে। ২০৯৫ থেকে ২১০০ সালে সম্ভাব্য গড় আয়ু হবে ৮৩ বছর। এ পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশক থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনমিতিক সূচকের ব্যাপক অগ্রগতি প্রশংসনীয়: জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, পরিবারপ্রতি গড় সন্তান ২ দশমিক শূন্য ৪, মাতৃমৃত্যু ১ দশমিক ৬৩ (প্রতি হাজারে জীবিত জšে§), নবজাতকের মৃত্যু শূন্য থেকে ২৮ দিন ১৫ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জšে§), শূন্য থেকে ১ বছরের শিশুমৃত্যু ১১ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জšে§), শূন্য থেকে ৫ বছরের শিশুমৃত্যু ২৮ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জšে§), পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ, অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ দশমিক ৮ বছর।

বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শহরে বাস করছে এবং এই ধারা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শহুরে জনসংখ্যা প্রায় ৬৮ শতাংশ হবে। ফলে শহরের অবকাঠামো এবং পরিষেবার ওপর বিশাল চাপ পড়বে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এই চাপ আরও বেশি হতে পারে, যেখানে শহরের পরিষেবাগুলো ইতোমধ্যে সীমিত। শহুরে জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। ডঐঙ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ করতে হলে আরও হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন হবে।

শহুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবহন এবং অবকাঠামো ক্ষেত্রে চাপ বাড়ছে। ডড়ৎষফ ইধহশ-এর তথ্য অনুসারে, শহরগুলোতে যানজট, বায়ুদূষণ এবং পানির সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং টেকসই অবকাঠামো পরিকল্পনার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। অধিক জনসংখ্যার কারণে খাদ্য ও পানির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর প্রভাব ফেলে। কৃষি জমির সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপর্যাপ্ততার কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে যেতে পারে।

আজকের বিশ্বে বিপুল জনসংখ্যাকে কেবল সমস্যা মনে করলে চলবে না। সঠিক পরিকল্পনা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগ একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০