নিজস্ব প্রতিবেদক:গাড়ি নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস নবায়ন) সময় গাড়ির মালিককে অগ্রিম কর দিতে হয়। গাড়ির সিসিভেদে এই করের পরিমাণ ২৫ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। একই মালিকের একাধিক গাড়ি থাকলে আরও ৫০ শতাংশ বেশি অগ্রিম কর দিতে হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একাধিক গাড়ি থাকলে তাতে ‘পরিবেশ সারচার্জ (কার্বন ট্যাক্স)’ আরোপ করা হয়েছে। গাড়ির সিসিভেদে প্রত্যেকটি গাড়ির জন্য এই করের পরিমাণ ২৫ হাজার থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এক গাড়িতে এক ব্যক্তি বা করদাতাকে অগ্রিম কর দিতে হচ্ছে। একই গাড়িতে আবার পরিবেশ সারচার্জ দিতে হবে। একই গাড়িতে দু’বার কর কেনÑএ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)।
সংগঠনের দাবি, আমদানি করা জাপানি গাড়ি সর্বাধিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব। বিষয়টি বুয়েট থেকে ও সরকারের পক্ষ থেকে পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব গাড়ি থেকে কার্বন নিঃসরণের সুযোগ নেই। ফলে গাড়ি ব্যবহারকারীদের পরিবেশ সারচার্জ দেয়া যৌক্তিক নয়। পরিবেশ সারচার্জ বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একই গাড়িতে দু’বার কর বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা ক্লাবে বারভিডা আয়োজিত ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বিষয়ে’ সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্ন তোলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মো. হাবিব উল্লাহ ডন। এ সময় সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এনবিআর সূত্রমতে, বর্তমানে গাড়ি (রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস নবায়ন) অগ্রিম কর দিতে হয়। মোটরকার, জিপ বা মাইক্রোবাসে সিসিভেদে অগ্রিম নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে ১৫০০ সিসির কম ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির ২৫ হাজার টাকা, ১৫০০ থেকে ২০০০ সিসি পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩৫০০ সিসির বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকা এবং মাইক্রোবাসে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম আয়কর ধার্য রয়েছে। বিআরটিএতে ব্যক্তিগত গাড়ি (যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক ও লরি, অ্যাম্বুলেন্স ও স্কুলবাস ব্যতীত) রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ, মালিকানা সনদ নেয়া ও নবায়নের বিপরীতে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়। আবার এক ব্যক্তির নামে একাধিক গাড়ি হলে দ্বিতীয় গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় আগের গাড়ির চেয়ে ৫০ শতাংশ কম অগ্রিম কর দিতে হয়। গাড়ি নিবন্ধনের সময় এক বা একাধিক গাড়ি থাকলে গাড়ির মালিককে কর দিতে হয়।
অপরদিকে, প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে গাড়িতে পরিবেশ সারচার্জ (কার্বন ট্যাক্স) আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো করদাতার নামে একাধিক মোটরগাড়ি (কার, জিপ ও মাইক্রোবাস) থাকলে একের অধিক প্রত্যেকটি গাড়ির জন্য সিসিভেদে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হবে। এর মধ্যে ১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াট পর্যন্ত ২৫ হাজার, ১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াট থেকে ২০০০ সিসি বা ১০০ কিলোওয়াটের মধ্যে ক্ষমতাসম্পন্ন ৫০ হাজার, ২০০০ সিসি বা ১০০ কিলোওয়াট থেকে ২৫০০ সিসি বা ১২৫ কিলোওয়াটের মধ্যে ক্ষমতাসম্পন্ন ৭৫ হাজার, ২৫০০ সিসি বা ১২৫ কিলোওয়াট থেকে ৩০০০ সিসি বা ১৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতার দেড় লাখ, ৩০০০ সিসি বা ১৫০ কিলোওয়াট থেকে ৩৫০০ সিসি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের দুই লাখ এবং ৩৫০০ সিসি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের ঊর্ধ্বে প্রতিটি গাড়ির জন্য দিতে হবে সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
ডলার-সংকটের কারণে আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে। ফলে গত ছয় মাসে দেশে মাত্র ২ হাজার ৮০০টি রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানি হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম বলে জানিয়ে বারভিডা বলছে, স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজারের মতো গাড়ি আমদানি হয়। ফলে গত ৬ মাসে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার গাড়ি আমদানি হওয়ার কথা থাকলেও এসেছে তার চার ভাগের এক ভাগ। তবে ডলার সংকটের মধ্যে অনেক ব্যাংক মালিক নতুন গাড়ি আমদানির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে বারভিডা। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাজেটে বারভিডার দাবিগুলো অনেকাংশে প্রতিফলিত হয়নি। সরকারের নীতি গ্রহণের সময় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে সবার জন্য সুবিধা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাটেগরির গাড়িতে শুল্ক-কর পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব তুলে ধরেন সংগঠনটির নেতারা।
বারভিডার সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘ডলার-সংকটের কারণে ব্যবসা কিছুটা কমলেও আমরা সহ্য করে নিচ্ছি। কারণ সরকার আমাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে দেশের এই সংকটে আমদানি একেবারে বন্ধ না করলেও লাগাম টানতে হবে। তবে রিকন্ডিশন গাড়ি কম এলেও নতুন গাড়ির ব্যবসায়ীরা আমদানি করছেন। বিশেষ করে ব্যাংক মালিকরা, যারা গাড়ির ব্যবসা করেন, তারা ডলার পাচ্ছেন এবং ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন।’
বারভিডা সভাপতি বলেন, ‘আমরা বাজেট প্রস্তাবে তাই জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড গাড়ির সিসি সø্যাব ও সম্পূরক শুল্কহার পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করেছিলাম, যাতে এসব গাড়ি আমদানি সহজলভ্য হয় এবং দেশের ভোক্তাশ্রেণি উপকৃত হয়। পাশাপাশি এতে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেত।’ কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে হাইব্রিড গাড়ি (১৮০১ সিসি থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত) আমদানিতে শুল্ক হ্রাস না করায় তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে উল্লেখ করেন হাবিব উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।’
হাবিব উল্লাহ আরও বলেন, ‘এছাড়া ফসিল ফুয়েলচালিত গাড়ির সিসি সø্যাব ও সম্পূরক শুল্কহার পুনর্বিন্যাস এবং জ্বালানির প্রাপ্যতা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের সময়ে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানি ও ব্যবহার বৃদ্ধি বড় রকমের স্বস্তি দিতে পারে। আমরা তাই বৈদ্যুতিক গাড়ির বিদ্যমান ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিলাম। সেটা আবার বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ দেশে বিদ্যুৎ-সংকটের মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাপক আমদানি কতটা যৌক্তিক হবে, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘বিদ্যুতের এ সংকট সাময়িক। তাই এ সমস্যার জন্য বড় সম্ভাবনার খাত আটকে রাখা যায় না। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গাড়ি বিদ্যুৎ-চালিত হওয়ার একটা পরিকল্পনা আছে। এ জন্য ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে ম্যাপিং করে চার্জিং স্টেশন বসানোর ব্যাপারেও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।’
মাইক্রোবাসকে গণপরিবহন হিসেবে উল্লেখ করে এর ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানায় বারভিডা। সংবাদ সম্মেলনে বারভিডার সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি আবদুল হকসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।