নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়নে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা, ভর্তুকির অর্থ সমন্বয় এবং মুদ্রানীতি। সবকিছু মিলিয়ে বাজেট হয়েছে ধনীবান্ধব, সেখানে বঞ্চিত হয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম বিত্তরা। পাশাপাশি সরকার যে সব লক্ষ্য নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
গতকাল আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স (অ্যামচ্যাম) আয়োজিত বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় এসব কথা বলেন বক্তারা। তবে বক্তারা বলছেন, এখনও অনেক সময় আছে। সরকার চাইলে প্রস্তাবিত বাজেটের অনেক পরিবর্তন আনতে পারে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। সভা সঞ্চালনা করেন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ এরশাদ আহমেদ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑরাজস্বের কম আহরণ, ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখার সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকা। তিনি আরও বলেন, প্রতিবছরই রাজস্ব আহরণ কম হয়। সামনের দিনেও হয়তো এমন হবে। কিন্তু সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা বাজেটে নেই। যে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া দরকার, সেগুলো অনুপস্থিত। এমনকি রাজস্ব বোর্ডের কোনো সংস্কারের কথা এখানে বলা হয়নি। আমাদের ভর্তুকি বেড়ে গেছে ৭২ হাজার কোটি টাকার মতো, যেটা প্রায় সাত থেকে আট বিলিয়ন ডলার এবং এটা আরও হয়তো বাড়বে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হয়তো এটা আরও বেড়ে যেতে পারে। কারণ এটা বাইরের পণ্যের মূল্যের ওপর নির্ভরশীল। তবে কোথা থেকে কীভাবে এই ভর্তুকি মেটানো হবে, তার কোনো রূপরেখা নেই।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাজেটের অর্থায়ন। বাজেটের ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু বর্তমানে এখানে দুটি জিনিস করা হয়েছে। বৈদেশিক উৎস থেকে আনবে, সেটা ভালো কথা। কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ ১১ বিলিয়ন ডলার। দু’বছর আগে তা ছিল ছয় বিলিয়ন ডলার। ঘাটতির এই বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে বলা হয়েছে, সে জায়গায় ব্যাংক খাত প্রস্তুত কি না, তা মাথায় রাখতে হবে। ব্যাংক খাতে বর্তমানে তারল্য সংকট বিরাজ করছে, তাহলে কীভাবে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে? এ চ্যালেঞ্জ কিন্তু এখানে রয়েছে।
বাজেটের কিছু ভালো দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক ও তৈরি পোশাকবহিভর্‚ত রপ্তানিমুখী খাতে করের হার অভিন্ন রাখা হয়েছে। এতে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা আছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে হয়তো আরও কিছু টাকা বেশি দিয়ে বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করতে পারলে হয়তো তাদের খাবারে প্লেটে আরও কিছু খাবার যোগ করা যেত। তবে সরকার মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পন্থা অবলম্বন করা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় এমন কিছু বলা হয়নি যে, মূল্যস্ফীতির ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কী ধরনের মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হবে। প্রধানত, মূল্যস্ফীতিকে সমন্বয় করা হয় মুদ্রানীতি দিয়ে। কিন্তু সুদের হার ছয় শতাংশ ও ৯ শতাংশ বেঁধে দিলে মুদ্রানীতির কার্যকারিতা থাকে না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ মোট বিনিয়োগের মাত্র এক শতাংশের মতো। কিন্তু সরকার বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলেছে, অথচ কীভাবে বিনিয়োগ বাড়াবে তার দিকনির্দেশনা নেই। বেশি রাজস্ব আহরণের তাগিদ নেই; নেই কোনো সংষ্কার। তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবায়ন কঠিন হবে, নানা চ্যালেঞ্জ-সমস্যায় পড়তে হবে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা বাজেটের অনুপাতে খুবই কম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সব সমাজেই বৈষম্য আছে। তবে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দিয়ে বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করছে। কিছু ত্রæটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। তবে আমরা সেগুলো কমানোর চেষ্টা করছি। আমাদের দেশ যে ওপরের দিকে উঠছে, এটা স্বীকার করতে হবে। এটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। ওপরে ওঠার গতিটা ভালো। মন্ত্রী বলেন, তবে একটা নায়ক আমাদের মধ্যে আছে, যা আমাদের এই অর্জনকে নামিয়ে দিতে পারে; অতীতেও নামিয়েছে। তা হলো আমাদের মধ্যকার মতভিন্নতা ও মতদ্বৈধতা। এটা সবার কাজে সরাসরি আঘাত করছে। আমরা যদি সামাজিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারি, চিরাচরিত অভ্যাস পরিবর্তন করতে না পারি, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করি, তাহলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হবে।