Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 3:22 pm

প্রস্তাবিত বাজেট সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক

নিজস্ব প্রতিবেদক ; একটি বাজেট ভালো নাকি মন্দ, তা বিচার করতে হবে কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই মানদণ্ড হচ্ছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। বাজেটের বিভিন্ন বরাদ্দ ও ঘোষণা সরকারের এসব নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যত বেশি সহায়ক হবে, একটি বাজেট তত বেশি সফল হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারের বাজেট এসব নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বাজেটের বিভিন্ন পদক্ষেপ সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে গতকাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম বায়হান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা।
সেলিম রায়হান বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিভিন্ন সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা। আর বর্তমানে সারাবিশ্বেই উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিশেষ করে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি আটকে রাখার সুযোগ নেই। এমন বাস্তবতায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো দরকার ছিল। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির দুই শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও বিভিন্ন বৃত্তি বাদ দিলে দেখা যাবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশের বেশি হবে না।
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অনেক কম। এ খাতে জিডিপির এক শতাংশেরও কম বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা নেই। কিন্তু অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা জোরদার করার জন্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। ফলে সাধারণ মানুষ সরকারের তরফ থেকে স্বাস্থ্যসেবায় উপযুক্ত সহায়তা পাচ্ছে না। এতে করে চিকিৎসার জন্য রোগী ও তার স্বজনদের ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে।’ এছাড়া বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, বাজেটে সে পরিমাণ বরাদ্দ নিশ্চিত করা হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সেলিম রায়হান বলেন, এ বছরের বাজেট-পরবর্তী সময়ে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে যত আলোচনা হচ্ছে, বাজেটের মূল কাঠামো নিয়ে ঠিক ততটা হচ্ছে না। অর্থ পাচারের আলোচনা বেশি হওয়ার ফলে বাজেটের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। তবে সানেম মনে করে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দেয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। এতে করে ভালো করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন। তিনি বলেন, অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কথা বলার আগে অর্থ পাচার হলো কীভাবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত এবং পাচারের রাস্তাগুলো বন্ধের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
তিনি বলেন, কভিডকালে দেশে নতুন করে বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসহায়ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। কিন্তু বাজেটে সে বিষয়ের প্রতিফলন নেই। আমরা যদি সঠিকভাবে সমস্যা চিহ্নিত করতে না পারি, তাহলে আমরা সমাধানের পথেও হাঁটতে পারব না। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে চলছে কি না, সেদিকটাতে নজর দেয়া জরুরি। তিনি আরও বলেন, ‘এখনকার বাস্তবতায় প্রয়োজন ছিল মাথাপিছু ভাতার বরাদ্দ বাড়ানো। একই সঙ্গে আমরা চেয়েছিলাম, ওপেন মার্কেট সেল বা ওএমএসে বরাদ্দ বাড়ানো হোক। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এবার উল্টো ওএমএসে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। নিন্ম আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে।’ করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা হলে সরকারের খুব বেশি ক্ষতি হতো না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এর আগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় সায়মা হক বিদিশা বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকে দারিদ্র্য বিষয়ে সরকারি পরিসংখ্যান নেই। সেই ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের মোট সম্পদের ৩৮ শতাংশ ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর হাতে পুঞ্জীভূত। আর কভিডকালে বৈষম্য আরও বেড়েছে, যদিও এ বিষয়ে সরকারি পরিসংখ্যান নেই। এ বাস্তবতায় বৈষম্য কমাতে তিনি কর কাঠামো সংস্কারের পরামর্শ দেন। আর বৈষম্য কমানোর জন্য প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর ও সম্পদ কর আহরণের পাশাপাশি করজাল সম্প্রসারণের ওপর জোর দেন। তিনি আরও বলেন, তথ্যের ঘাটতি একটি বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে কভিডের সময় তা আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। তখন দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো দারিদ্র্য নিয়ে বেশ কয়েকটি জরিপ করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সেরকম জরিপ বা গবেষণা করা হয়নি। আবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর জরিপ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সানেমের গবেষণা দলের সদস্য ফারহিন ইসলাম, তুহিন আহমেদ, ইসরাত শারমিন, নাদীম উদ্দিন আফিয়া মোবাসশাহির তিশা, সামানত রহমান, কানিজা মুহাসিনা প্রমুখ।